উপকূলে মৎস্যজীবীদের বড় অংশ নারী হলেও স্বীকৃতি নেই
দেশের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নারী হলেও তাদের কাজের স্বীকৃতি নেই। উপকূলে যেসব জেলের কার্ড রয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ নারী, বাকি ৯৬ শতাংশ কার্ডধারী জেলে পুরুষ। যদিও পুরুষেরা মাছ ধরতে যান; আর বাকি সব কাজের বড় অংশই হয় নারীর হাত দিয়ে। মাছ কাটা, বাছাই করা, শুঁটকি করা, পোনা ধরাসহ বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন নারীরা। এই নারীদেরও জেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কনফারেন্স হলে গত বুধবার মৎস্যজীবীদের নিয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়। সেখানে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মাছ ধরা সব সময় ‘পুরুষের কাজ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। নারীদের জেলে হিসেবে স্বীকৃতি নেই বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের জেলে কার্ড পাওয়ার সংখ্যা খুব নগণ্য। এর পাশাপাশি নারীরা পুরুষ জেলের তুলনায় আয়ের ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। কিছু অঞ্চলে দেখা যায়, নারীরা সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকার ও বিক্রির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। তবে তাঁদের অধিকাংশ সময় যায় মাছ কাটা ও বাছাই করতে। সে ক্ষেত্রে কাটা ও বাছাইকরণকে কতটুকু মৎস্যজীবী পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়, তা নিয়ে নারীরা বিভ্রান্তিতে ভোগেন।
এ ছাড়া কার্ডধারী ও যারা কার্ড পাননি, বেশির ভাগ নারীই এ বিষয়ে সচেতন নন। ফলে কীভাবে জেলে কার্ডের জন্য আবেদন করতে হয়, তা জানেন না। ৯৩ শতাংশ নারী জেলে স্বাস্থ্যগতভাবে অসুস্থ থাকেন এবং যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা পান না। উপকূল অঞ্চলে পানির লবণাক্ততার কারণে নারীদের বঞ্চনা অধিক মাত্রায় লক্ষ করা যায়। নারী জেলেরা লবণাক্ত পানিতে অনেক সময় ব্যয় করেন, প্রায়ই তাঁরা বিভিন্ন অসুস্থতায় ভোগেন। ৪০ শতাংশ বিধবা বা একক আয়কর্তা নারীদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয় মৎস্য আহরণ করতে।
সেমিনারে ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অঞ্চলের নারী মৎস্যজীবীদের নীতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ৯৩ শতাংশ নারী জেলে স্বাস্থ্যগতভাবে অসুস্থ এবং কোনো ধরনের বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা পান না; ৪০ শতাংশ নারী বিধবা বা একক আয়কর্তা হিসেবে আছেন; ২৫ শতাংশ নারী সামাজিক সুবিধা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত, শতভাগ নারী দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নেন; ২ শতাংশ নারী বিগত এক বছরে যেকোনো ধরনের স্কিমের সুবিধা পেয়েছেন; ৯৮ শতাংশ নারী ও পুরুষ মৎস্যজীবী কোনো না কোনো এনজিওর সঙ্গে যুক্ত।
শুধু তা–ই নয়, জেলেরা দিনে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা লোনাপানিতে থাকার কারণে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হন। এ ছাড়া মাথাব্যথা, লোনাপানিতে শরীর ছিলে যাওয়া, চামড়া কালো ও সাদা হয়ে ওঠা এবং জরায়ুতে সংক্রমণ হয়। লোনাপানির ফলে পায়ের নিচে ও শরীরে সাদা ছত্রাক দেখা দেয়।
উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী (কুয়াকাটা), বাগেরহাট (মোংলা) ও কক্সবাজার সদরের ১৫০ নারী ও ১৫০ পুরুষ মৎস্যজীবীর ওপর এই গবেষণা চালায় মৎস্যজীবীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাদাবন সংঘ।
নারী জেলেদের প্রতি এসব বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেমিনারে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে বাদাবন সংঘ। সেগুলো হলো ‘জেলে’ শব্দকে জেন্ডার–সমতায় আনার জন্য ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ মৎস্যজীবী শব্দে অন্তর্ভুক্ত করা; শ্রম আইন ২০০৬-এ মৎস্যজীবীদের জন্য আইন স্পষ্ট করা গেলে মৎস্যজীবীদের শ্রমিক হিসেবে যথাযথ সহযোগিতা করা; জেলে নিবন্ধন করার জন্য মাঠপর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের অবহিতকরণ করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া; নারী জেলেদের নিয়ে ‘মহিলা/নারী’ শব্দ ব্যবহার করে সমবায় সমিতি নিবন্ধন করার জন্য সচেতনতা প্রয়োজন; কিছু অঞ্চলে নারীরা সমুদ্রে গিয়ে মাছ কাটেন ও বাছাই করেন। তাঁদের ‘মৎস্যজীবী’ হিসেবে গণ্য করা; নারী মৎস্যজীবীদের স্বাস্থ্যগত ও সুরক্ষা ঝুঁকি নিরসনে উপকূল অঞ্চলে মৎস্য অধিদপ্তরের চলমান প্রকল্পে অধিক গুরুত্ব দেওয়া; যেসব এলাকায় জেলে নিবন্ধন তালিকা হালনাগাদকরণ কার্যক্রম অব্যাহত নেই, তা চলমান করার উদ্যোগ নেওয়া।
এ সময় জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মৎস্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা, ম্যান্ডেট, বাংলাদেশের জলসম্পদের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক উৎস, মৎস্য খাতে সাম্প্রতিক অর্জন, অভ্যন্তরীণ মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষের কার্যক্রম, ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং উপকূলীয় মৎস্য চাষের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।
যোগাযোগবিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক শাহানা হুদা রঞ্জনার সঞ্চালনায় সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান, বাদাবন সংঘের নির্বাহী পরিচালক লিপি রহমান, ইলিশ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের উপপরিচালক মাসুদ আরা মমি, সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক সামিয়া সুলতানা, গবেষক আমিনুর রসুলসহ মানবাধিকারকর্মী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নারী জেলেদের প্রতিনিধিরা।