ভোরে কেনা কুমিল্লার সবজি দুপুরের আগেই উঠছে সন্দ্বীপের মানুষের পাতে

সীতাকুণ্ড–সন্দ্বীপ রুটে চলছে ফেরি কপোতাক্ষফাইল ছবি

সন্দ্বীপ চ্যানেলে ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার পর যাত্রী পারাপারের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও পুরোদমে শুরু হয়েছে।  ট্রাকভর্তি সবজিসহ কাঁচা পণ্য সহজেই নেওয়া যাচ্ছে সাগরঘেরা দ্বীপটিতে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার আগে ট্রলারে করে পণ্য আনা–নেওয়া হতো দ্বীপটিতে। এতে একই পণ্য অন্তত চারবার ওঠানো–নামানো করতে হতো। এতে খরচ ও সময় বেশি লাগত। সোমবার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কপোতাক্ষ ফেরি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরি চলাচল শুরু হয়।

বুধবার সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে ছেড়ে আসা ফেরিটি সকাল ১০টায় ভিড়েছে গুপ্তছড়া ঘাটে। ফেরি থেকে নামার সময় সবজিবাহী ট্রাকের চালকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ভোররাতে এটি কুমিল্লার নিমশাহ থেকে ফেরির উদ্দেশে ছেড়ে আসে। এ সময় পাশের সিটে বসা ছিলেন একজন পাইকারি বিক্রেতা। সময় কম লাগছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোরে কুমিল্লা থেকে কেনা সবজি এখন দুপুরের আগেই সন্দ্বীপের মানুষের পাতে তুলে দিতে পারছি।’

উত্তর সন্দ্বীপের সবচেয়ে বড় বাজার আকবর হাটের সবজির আড়তের মালিক মো. আকবর হোসেন জানিয়েছেন, ‘ফেরি চালু হওয়ার পরদিন এক ট্রাক সবজি নিয়ে এসেছি। এতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। ফেরি চালুর আগে কুমিরা ঘাট দিয়ে ট্রলারে সবজি আনতে হতো। তখন সন্দ্বীপ চ্যানেলের দুই পাড়ে দুবার করে মাল ওঠানো–নামানো করতে হতো। এতে একদিকে যেমন সময় বেশি লাগত, অন্যদিকে টানাহেঁচড়ায় মাল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতো।’

চৌমুহনী বাজারের ‘মা-বাবার দোয়া’ আড়তের ব্যবস্থাপক রাজীবও একই রকমের তথ্য দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ফেরি সার্ভিস আমাদের ব্যবসাকে সহজ করে দিয়েছে। আগে আমাদের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সবজি নষ্ট হয়ে যেত। এখন পুরোটা তাজা দেখতে পাচ্ছি। খরচ কেমন কমেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খরচ কিছুটা কমেছে, পুরোটা হিসাব করে দেখার সময় নেই হাতে।’ একই বাজারের পূজা বাণিজ্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে আসা একটি ট্রাক থেকে মাল খালাস হচ্ছে। এটির মালিক জয়দেব মুহুরীও খরচ কিছু কমে আসার কথা জানিয়েছেন।

শুধু কাঁচামালই নয়, বড় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে করে ফার্নিচার, রড, সিমেন্টসহ হরেক রকমের মালামাল পরিবহন হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে সন্দ্বীপ থেকেও মালভর্তি ট্রাক ফেরিতে উঠছিল। সেসব ট্রাকের কোনোটিতে লোহার টুকরা আবার কোনোটিতে ঢেউ টিন নিয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চালকেরা।

পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি যাত্রীরাও এখন সহজেই সন্দ্বীপ চ্যানেলে পাড়ি দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে রূপসী সন্দ্বীপ, লুসাই পরিবহন লিমিটেড ও কালু শাহ এন্টারপ্রাইজের ছয়টি বাসে যাত্রীসেবা চালু হয়েছে। বুধবার চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে সন্দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে আসে ‘রূপসী সন্দ্বীপ’ বাস পরিবহনের দুটি বাস। ফেরি থেকে নেমে আসতেই কথা হয় একটি বাসের চালক মো. করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ৬টায় চট্টগ্রামের হালিশহরের বিডিআর মাঠ থেকে যাত্রী নিয়ে ফেরিতে করে সকাল ১০টায় সন্দ্বীপের স্থলভাগে পৌঁছেছি। গুপ্তছড়া ঘাট থেকে গন্তব্যস্থল এনামনাহারে পৌঁছাতে তাঁর আরও ১৫ মিনিটের মতো সময় লাগতে পারে।’ এই বাসের একজন যাত্রী মো. রাকিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে সন্দ্বীপে আসতে পারব, এটা একটা স্বপ্ন ছিল। এখন বাস্তব। মাত্র তিন শ টাকা ভাড়ায় হালিশহর থেকে সন্দ্বীপে পৌঁছালাম।’

চট্টগ্রামের পাশাপাশি ঢাকা থেকেও যাত্রী পরিবহন করছে বিআরটিসি বাস। ঢাকার ফকিরাপুল থেকে রাত ১২টায় ছেড়ে আসা একটি বাসের যাত্রী মো. শিপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। ঢাকা থেকে এসি বাসে করে সন্দ্বীপ পৌঁছাতে খরচ হয়েছে ৮০০ টাকা। ফেরি সুবিধা না পেলে খরচ পড়ত দেড় হাজার টাকার বেশি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসা যাত্রীরা বাসে চেপে সন্দ্বীপে পৌঁছাতে পেরে যাত্রীদের উচ্ছসিত দেখা গেছে।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেরিতে চলাচলে দুই প্রান্তের ওঠা-নামায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না। ট্রলার, স্পিডবোট ও শিপে চড়ে যাতায়াতে দুই প্রান্তেই কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া উভয় প্রান্তের জেটি পার হয়ে উঠতে হয় ভ্যানগাড়িতে। হিসাব করে দেখা গেছে, হালিশহর থেকে ঘাটে পৌঁছাতে যাত্রীপ্রতি খরচ পড়ে ২০০ টাকা। স্পিডবোটে ২৫০ টাকা এবং দুই দিকের ভ্যানের ভাড়া ৫০ টাকা। গুপ্তছড়া ঘাট থেকে এনাম নাহারে লোকাল সার্ভিসে ভাড়া পড়ে ৫০ টাকা। সব মিলিয়ে জনপ্রতি ন্যূনতম ৫৫০ টাকা খরচ পড়ে। ফেরি চালু হওয়ার পর জনপ্রতি খরচ সাশ্রয় হচ্ছে ৪৬ শতাংশ বা ২৫০ টাকা।

বিআইডব্লিউটিসির উপপরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ফেরির ধারণক্ষমতার পুরোটাই ব্যবহার হচ্ছে। এতটা সাড়া পাব ভাবিনি। এখন আমাদের গাড়ি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত লোকবলের দরকার হচ্ছে।

দেশে এই মুহূর্তে সাগর উপকূলে চলাচলের উপযোগী ফেরি না থাকায় অভ্যন্তরীন নদীপথের জন্য তৈরি ‘কপোতাক্ষ’ এই পথে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সাগর উপকূলে চলাচলের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে এই পথের জন্য ফেরির অর্ডার করা হয়েছে। আগামী অক্টোবরে যেটি এই রুটে সেবা দেওয়া শুরু করার কথা। আপাতত যত দিন সম্ভব ফেরি কপোতাক্ষ এই রুটে চলাচল করবে। এরপর  বিআইডব্লিউটিসির একাধিক সি-ট্রাক দিয়ে সেবা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।