এবার গরম কেমন পড়বে

ড্রাইওয়াশের দোকানটির মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি কম্ফোর্টার, কম্বল। শীত নিবারণের এসব সামগ্রী ধোয়ার জন্য এখন অর্ডার আসছে বেশি, জানালেন দোকানি। রাজধানীর মণিপুরী পাড়ার একটি মার্কেটে আছে দোকানটি। এর মালিক আবু সাঈদ বলছিলেন, ‘এখন ওয়াশের জন্য শীতের পোশাকই আসতেছে বেশি। তবে এবার শীত কম হইছে, তাই পোশাক-আশাক আগের চ্যায়া কম। মানুষ মনে হয় বেশি কাপড় বাইর করে নাই।’

এই দোকানির সঙ্গে কথা হয় ৩ মার্চ সন্ধ্যায়। মধ্য ফাল্গুনের এই সময়ে শীত কমে আসে অনেকটাই। শীত আটকাতে রাখা কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী তাই ধুয়ে দেরাজে তুলে রাখার সময় এখন।

রাজধানীসহ অনেক স্থানেই গরম পড়ছে একটু একটু করে। মাস তিন–চারেক বন্ধ রাখা বাসার বৈদ্যুতিক পাখাগুলো চালু করছেন অনেকেই। চলতে শুরু করেছে এসি। পাখার সুইচগুলো কোনোটায় বাড়ে-কমে, সাময়িক অনভ্যস্ততা তাও হয়তো ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি তো ভুল করে না। ঋতু পরিবর্তনের নিয়ম মেনে ঠিকই গরম আসছে। মার্চ গরম কালের প্রথম মাস।

ব্যাঙের তো সর্দি হয় না। গ্রীষ্মপ্রধান বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে গরম নিয়ে তাই ভীতি থাকারও কথা নয়। কিন্তু গরমকাল এখন কেমন জানি ভয়ানক রূপ নিয়ে হাজির হয়।

গত বছরের কথাই ধরা যাক। গত বছর দেশে তাপমাত্রা যা ছিল, তা ৭৬ বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, গত বছর ইতিহাসের সর্বোচ্চ উষ্ণ বছর ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস যতটা উষ্ণ ছিল, তাও বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। গরমের একের পর এক রেকর্ড ভঙ্গের এসব ঘটনায় এবারের সম্ভাব্য গ্রীষ্মকালের অবস্থা কেমন হতে পারে?

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, গরম কেমন পড়বে এর সঙ্গে প্রাকৃতিক নানা বিষয় জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে আছে বৈশ্বিক বায়ুপ্রবাহ, সূর্যের অবস্থান, ঊর্ধ্ব আকাশে-বাতাসের আবর্তন, সাগরে জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হওয়া বা না–হওয়া, স্থানীয় নানা উৎসের অবদান।
উষ্ণতম জানুয়ারি, উষ্ণ শীতের ৩ মাস

এ বছরের জানুয়ারি মাস ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস এ পরিসংখ্যান দিয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারির তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ নিয়ে গত বছরের (২০২৪) জানুয়ারির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

এবার দেশে শীত তেমন পড়েনি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। আর সদ্য বিদায়ী ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা বেশি ছিল ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা অনেকটাই বেড়ে গেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতিমধ্যে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলেছে, মার্চ মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ৯ মার্চের পর থেকেই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করতে পারে। আর এটা অব্যাহত থাকবে। শীতের মাসগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা এবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, গরম অনেকটাই পড়বে।

এল নিনো ও লা নিনার অবস্থা

বৈশ্বিক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব আছে। এগুলো হলো প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর বাতাসের ধরন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। এল নিনো বলতে বায়ুপ্রবাহের উষ্ণ পর্যায়কে বোঝায়। অন্যদিকে লা নিনা বোঝায় এর শীতল পর্যায়কে।

২০২৪ সালের জুলাই থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছিল। এর আগে, মহাসাগরের উপরিতলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল, যা আবহাওয়াবিদদের ভাষায় ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি হিসেবে পরিচিত।

তবে চলতি বছরে লা নিনা প্রাধান্যশীল বলে ধরা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, গরম অত তীব্র নাও হতে পারে। কিন্তু আবহাওয়ার বিভিন্ন মডেল ব্যাখ্যা করে আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, লা নিনার প্রভাব অনেকটাই কমে আসছে।

যুক্তরাজ্য আবহাওয়া অফিসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাডাম স্কাইফ বলেন, ‘মজার বিষয় হলো, ২০২৫ সালের উষ্ণ বৈশ্বিক তাপমাত্রার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যদিও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল লা নিনা পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা কিছুটা শীতল পরিস্থিতি তৈরি করছে।’

অ্যাডাম স্কাইফের ভাষ্য, ২০২৫ সালের মতো বছরগুলোতে যখন এল নিনোর উষ্ণায়নের প্রভাব নেই, সেই সময় আরও শীতল হওয়া উচিত। ২০১৬ সাল ছিল এল নিনোর বছর এবং সেই সময়ে এটি ছিল বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার রেকর্ডের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। যদিও ২০২৫ সালের জন্য আমাদের পূর্বাভাসের তুলনায়, ২০১৬ এখন স্পষ্টতই শীতল দেখাচ্ছে।

আবহাওয়ার বৈশ্বিক পূর্বাভাসগুলো কী বলছে

জাপান আবহাওয়া সংস্থা গত ডিসেম্বরেই জানিয়েছিল, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত মহাসাগর থেকে পশ্চিম–উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে, দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার অনেক অংশসহ, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকবে।

অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম, পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, বুয়েট

বাস্তবেও তা–ই হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ না, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন পর্যন্ত অবস্থা মোটামুটি একই রকম ছিল।
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিসের ওয়েবসাইটে দেওয়া পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫ সাল বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রার নিরিখে উষ্ণতম বছরের মধ্যে একটি হতে পারে। ২০২৪ এবং ২০২৩ সালের ঠিক পরেই থাকবে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) ইতিমধ্যেই বলেছে, ২০২৪ সাল ছিল সবচেয়ে উষ্ণ বছর। প্রথমবারের মতো এটি প্রাক্‌-শিল্প (১৮৫০-১৯০০) স্তরের চেয়ে প্যারিস চুক্তির ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে। ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করেছি। সেটিও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল। সেই ধারাবাহিকতা ২০২৫–এও চলতে পারে বলে এ সংস্থা বলছে।

লা নিনার কারণে গরম যে খুব কমে যাবে, তা বলছে না জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকারি প্যানেল বা আইপিসিসি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লা নিনার শীতল প্রভাব সত্ত্বেও চরম তাপ এখনো উদ্বেগের বিষয়। এশিয়ায়, তাপপ্রবাহের তীব্রতা বেড়েছে, সেই সঙ্গে শীতের তীব্রতা কমে গেছে। প্রবণতা আগামী দশকগুলোতেও অব্যাহত থাকতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, এবার লা নিনার বছর হলেও গত বছরের চেয়ে তাপমাত্রা এবার অনেকটা কমে যাবে এমন সম্ভাবনা কম। গত বছরের উষ্ণ আবহাওয়ার ধারাবাহিকতা এবারও থাকতে পারে। এর জন্য যে শুধু বৈশ্বিক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিই কারণ, তা–ই নয়। গাছ উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ পরিবেশবিরুদ্ধ নানা কর্মকাণ্ডের ভূমিকা আছে।

বাংলাদেশে গরম কতটা পড়তে পারে

দেশের উষ্ণতম মাস এপ্রিল। এ মাসে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পরের মাস মে দেশের দ্বিতীয় উষ্ণতম মাস। গত বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ গরম পড়ে। ১৯৪৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে এত দীর্ঘ তাপপ্রবাহও দেখা যায়নি, যা হয়েছিল গত বছর। তখন তাপপ্রবাহ ছিল ১ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত টানা ৩৫ দিন।

গ্রীষ্মের উষ্ণতা প্রশমিত করে কালবৈশাখী ঝড়। এতে প্রবল বৃষ্টি হয়, তাতে কয়েক দিনের জন্য হলেও কমে যায় তাপ। তারপর আবার বাড়ে।

গত বছর এপ্রিল ও মে মাসে এই অস্বাভাবিক ও টানা তাপপ্রবাহের কারণ কালবৈশাখীর সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। সাধারণত এপ্রিল মাসে ৯ দিন এবং মে মাসে ১৩ দিন কালবৈশাখী হয়। কিন্তু গত বছর এপ্রিল মাত্র ২ এবং মে মাসে ৪টি কালবৈশাখী হয়েছিল বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা ও বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী নিয়ে গবেষণা করছেন।

মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক, জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ, আবহাওয়া অধিদপ্তর

আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, ‘কালবৈশাখীর সংখ্যা কমে যাওয়ার এ প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। এর বিপরীতে বাড়ছে তাপপ্রবাহ। গরমকালে তাপপ্রবাহ প্রশমনে বড় ভূমিকা রাখে কালবৈশাখীর ফলে সৃষ্ট ঝড় ও বৃষ্টি। আর এটি সৃষ্টি হয় মূলত জলীয় বাষ্পের কারণে।’

বাতাসে জলীয় বাষ্পের জোগান বাড়লে বৃষ্টি হয়। এপ্রিল ও মে মাসে এই বৃষ্টি ও ঝড় সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে জলীয় বাষ্প। কিন্তু তার সৃষ্টি হয় কেমন করে?

জলীয় বাষ্প সৃষ্টিতে সাগরে সৃষ্ট বায়ুর ভূমিকা আছে। গ্রীষ্মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় পুবালি হাওয়া। এর সঙ্গে পশ্চিম দিক থেকে আসা বায়ুর একটি সংঘাত হয়। উভয় বাতাসের গতি যদি বেশি হয় এবং নৈকট্য প্রকট হয়, তবেই জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হতে পারে বেশি মাত্রায়। আর জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হলে ঝড়ের উপাদান গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা তৈরি হয়। এটি প্রবল বাতাস ও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। দিন দিন গরমকালে এভাবে মেঘের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

আবহাওয়া–সংক্রান্ত বিভিন্ন মডেলের উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, এবার এপ্রিল ও মে মাসে মেঘ সৃষ্টির প্রবণতা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। কালবৈশাখীর সংখ্যাও বাড়তে পারে। আর তাতে গত বছর যেভাবে একটানা দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলেছে, তা নাও থাকতে পারে।

এরই মধ্যে দেওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, এই মার্চ মাসেও দেশে এক থেকে দুই ধরনের হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ এবং বজ্রঝড়ের সম্ভাবনা আছে।

এবার ঝড়–বৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি থাকলেও গরম তাতে কমে যাবে, তা কিন্তু কেউ বলছেন না। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। আর সেই সঙ্গে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, বন বিনাশ, গাছ ধ্বংসের মতো কারণগুলো রয়েছে। তাই তাপমাত্রা যা–ই থাকুক, গরমের অনুভূতি আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। সেই অনুভূতি এবারও যথেষ্ট থাকার আশঙ্কা আছে, আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিকের ধারণা তেমনই।