জেন্ডার বাজেট: বরাদ্দ বাড়লেও নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাসে অবদান রাখা নিয়ে প্রশ্ন
নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু অর্জিত হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে জেন্ডার বাজেটের সার্থকতা। এই বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় এ বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটি নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে যথেষ্ট নয়। এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী ও জেন্ডার–বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেন্ডার বাজেটের বরাদ্দ ও পরিধি আরও বাড়াতে হবে। এ বাজেট অনুসারে নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে নেওয়া পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা–ও পর্যালোচনা করতে হবে।
দেশে প্রথম জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন দেওয়া হয় ২০০৯ সালে। এর পর থেকে প্রতিবছর প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করার সময় আলোচনায় আসে জেন্ডার বাজেট। শুরুতে মাত্র চারটি মন্ত্রণালয়ের জন্য থাকত জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ। এখন থাকছে ৪৪টি মন্ত্রণালয়ের জন্য।
সুনির্দিষ্টভাবে নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছে এমন প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।সায়মা হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
জেন্ডার বাজেট আলাদাভাবে শুধু নারীর জন্য কোনো বাজেট নয়। মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য কোনো থোক বরাদ্দও নয়। জেন্ডার বাজেট হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব করে জাতীয় বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতার বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যায়। জেন্ডার বাজেটের লক্ষ্য হলো, সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি বা প্রকল্পে জেন্ডার সংবেদনশীলতা চিহ্নিত করে এমনভাবে বাজেট বরাদ্দ রাখা, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমে আসে বা সমতা প্রতিষ্ঠা হয়।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। এই মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২-২৩) থেকে জানা গেছে, ওই অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৪০২ কোটি টাকা; এটি মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। মোট বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দের হার ৩৫ শতাংশ। আর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের মধ্যে নারীর জন্য বরাদ্দ ৬৯ শতাংশ। জেন্ডারবিষয়ক সবচেয়ে বেশি প্রকল্প এই মন্ত্রণালয়ের। অথচ সার্বিকভাবে মন্ত্রণালয়টির জন্য বাজেট বরাদ্দ কম। এতে নারীরা কতটুকু সুবিধা পাবেন, সেটা একটি বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হকের মতে, শুরু থেকে দেশে একই ধাঁচে জেন্ডার বাজেট হয়ে আসছে। খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কিছু নির্ধারিত মানদণ্ড দেওয়া থাকে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় তাদের প্রকল্পগুলো সেই মানদণ্ড অনুসারে মূল্যায়ন করে উন্নয়ন বাজেট বিশ্লেষণ করে। আর নারীকর্মীর সংখ্যার অনুপাতে বিশ্লেষণ করে পরিচালন বাজেটের। এসব তথ্যের সুনির্দিষ্ট গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় জেন্ডার বাজেট কত, তা জানায়। তিনি বলেন, জেন্ডার বাজেট জানানোর চর্চা হচ্ছে, এটা ভালো দিক। তবে শুধু চর্চার জন্য নয়, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনের পথে এই বাজেটে কতটা এগোনো গেল, তা মূল্যায়ন করা দরকার।
চলতি অর্থবছরে যেভাবে জেন্ডার বাজেট হয়েছে
জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন ২০২৩-২৪ এ বলা হয়েছে, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাতীয় বাজেটে নারীর হিস্যা জানার পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর অগ্রগতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের পদক্ষেপ এবং নারীর উন্নয়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাম্প্রতিককালের অর্জন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
চলতি অর্থবছরে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জেন্ডার বাজেটে মোট বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
জেন্ডার বাজেটকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও সমাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি’ শিরোনামে প্রথম ভাগের আওতায় রয়েছে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ‘উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ’ শিরোনামে দ্বিতীয় ভাগের আওতায় রয়েছে ১১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ‘সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধি’ শিরোনামের তৃতীয় ভাগের আওতায় রয়েছে ২১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। তিনটা ভাগে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৫৮ শতাংশের বেশি, ৮ শতাংশের বেশি ও প্রায় ৩৪ শতাংশ।
উন্নয়ন বাজেটে নারী উন্নয়নে বরাদ্দের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের গৃহীত প্রকল্প ও কর্মসূচি কতটা জেন্ডার সংবেদনশীল বা নারী উন্নয়নে প্রাসঙ্গিক, তা যাচাইয়ে ১৬টি মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। মানদণ্ডগুলো হচ্ছে, নারীর প্রজনন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও পুষ্টির উন্নয়ন, নারীর অনুকূলে সরকারি সম্পদ ও সেবা পাওয়ার সুযোগ, নারী শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়ন, নারীর সার্বিক কর্মঘণ্টা হ্রাস করা, উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে নারীর অসহায়ত্ব, দুস্থতা ও ঝুঁকি হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক ফোরামে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর নিরাপত্তা ও চলাফেরা নিশ্চিতকরণ, নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, নারীর আইন ও বিচারপ্রাপ্তি, নারীর তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও তা ব্যবহারের সুযোগ, নারীর ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ প্রশমনে নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নারীর গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ।
এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রকল্প ব্যয়ের কত শতাংশ নারী উন্নয়নে ব্যয় হয় সেটির ওপর মূল্যায়ন হয়। যেমন, নারীর উন্নয়নে কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচির যদি সরাসরি কোনো প্রভাব না থাকে তবে শূন্য, উন্নয়ন লক্ষ্যভিত্তিক হলে ১০০ নম্বর ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ১ থেকে ৯৯ এর মধ্যে যেটি যুক্তিযুক্ত মনে হয়, সেই নম্বর দেওয়া হয়।
জেন্ডার বাজেটের সুফল পেতে যা দরকার
অধ্যাপক সায়মা হক জানালেন, জেন্ডার সমতা অর্জনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। সেই লক্ষ্যমাত্রার দিকে এ বাজেট নিয়ে কতখানি এগোনো গেছে, তা বুঝতে সঠিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন দরকার। বছরের শুরুতে বের করতে হবে নারীর ক্ষমতায়ন কতটা হলো। মধ্যমেয়াদে আবার একটি হিসাব বের করতে হবে। সমতা অর্জনে নারী কোথায় পিছিয়ে, তা চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। পরবর্তী বাজেটে জেন্ডার বাজেট বরাদ্দে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে, সেটি ঠিক করতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছে এমন প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করা জেন্ডার বাজেটকে কার্যকর করার প্রাথমিক কাজ বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নারীর প্রতি সামাজিক আচরণ এখনো সংবেদনশীল নয়। নারীর গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নেই। সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সম–অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কী কী কাজ করতে হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে অর্থায়ন করতে হবে। জেন্ডার বাজেট নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে। নারীর ক্ষমতায়নে নারী আন্দোলনের গুরুত্বের কথা ভেবে এ খাতেও অর্থায়ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।