মিছিল নিয়ে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে শহীদ পরিবার, চিফ প্রসিকিউটরের পদত্যাগ দাবি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আজ সোমবার দুপুরেছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পূর্বঘোষিত মানববন্ধন শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলেন জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আজ সোমবার বেলা একটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তাঁরা অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যান। কিন্তু ফটকের সামনেই তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ফটকের সামনে অবস্থানের পর ট্রাইব্যুনালে আরও বেঞ্চ বাড়ানো এবং চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে কর্মসূচি শেষ করেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। কর্মসূচিতে শাহবাগে অবস্থান করা জুলাই মঞ্চের সদস্যরাও অংশ নেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে অবস্থানের সময় শহীদ পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যাতে তাঁদের সঙ্গে এসে দেখা করেন, কথা বলেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা শহীদ পরিবারের সদস্যদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ভেতরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ভেতরে যেতে রাজি হননি। ফটকের সামনেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যান। চিফ প্রসিকিউটর তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। শেষে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা চিফ প্রসিকিউটরের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে কর্মসূচি শেষ করেন।

এর আগে বেলা একটার কিছু পরে প্রেসক্লাব থেকে মিছিল নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সামনে পৌঁছান মানববন্ধনকারী শহীদ পরিবারের সদস্যরা। হাইকোর্ট মাজার ও মসজিদসংলগ্ন ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে মিছিল নিয়ে যাওয়া শহীদ পরিবারের সদস্যদের বাধা দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর সেখানে যুক্ত হন শাহবাগে অবস্থান করা জুলাই মঞ্চের সদস্যরা। পরে এই দুই পক্ষ মিলে ফটকের সামনে বসে-দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন।

ট্রাইব্যুনালের সামনে এই অবস্থানে শহীদ শাহরিয়ার হাসানের বাবা আবুল হাসান অভিযোগ করেন, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আসামিদের সঙ্গে সমঝোতা করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তাঁরা শুনেছেন।

ঈদের পর আবার এখানে ঘোষণা দিয়ে আবুল হাসান বলেন, ‘সেদিন আমরা ট্রাইব্যুনাল ভাঙচুর করব, যদি তিনি (তাজুল) এই ট্রাইব্যুনালে থাকেন। দফা এক দাবি এক—তাজুলের পদত্যাগ। তাঁকে আমরা এখানে আর দেখতে চাই না। তিনি গোটা শহীদ পরিবারকে অপমান করেছেন, অপদস্থ করেছেন। তিনি শহীদ পরিবারের শত্রু, জাতির শত্রু। শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। নাম্বার ওয়ান মিরজাফর।’

তাজুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করে সন্তানহারা এই বাবা আরও বলেন, ‘তিনি যদি ঈদের পরে এই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বসেন, এই রঙ্গমঞ্চ ভেঙে ছারখার করে দেব। টুকরো টুকরো করে দেব। ওনার মতো অপরাধীর এখানে বসার কোনো অধিকার নাই।’

জুলাই মঞ্চের পক্ষ থেকে আরিফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা জুলাই মঞ্চ থেকে বলে দিতে চাই, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, অন্তর্বর্তী সরকার আমরাই বসিয়েছি। এই সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, সবাই সাক্ষী আছেন তিনি (চিফ প্রসিকিউটর) দেখা করেননি। ...তাঁর পদত্যাগ আমরা করিয়েই ছাড়ব।’ জুলাই মঞ্চ থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যের জন্য আরও বেঞ্চ বাড়ানোর এবং তাজুল ইসলামের অবস্থান পরিষ্কারের দাবি জানানো হয়।

গুম, খুনের বিচারের দাবিতে ‘জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে যায়। আজ সোমবার দুপুরে
ছবি: দীপু মালাকার

ট্রাইব্যুনালের বাইরে যখন এই বিক্ষোভ চলছিল, সে সময় ট্রাইব্যুনালের ভেতরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সে সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শহীদ পরিবারের অধিকার আছে তারা দাবি করবে, বিচার চাইবে, আসামিদের গ্রেপ্তার চাইবে—খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জায়গা থেকে, তারা তাদের বেদনার জায়গা থেকে দাবি জানাবে, এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ করবেন তাঁর আইনের নিজস্ব কাঠামোর মধ্য দিয়ে। আইনের নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে।’

এ প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা যেমন দ্রুততম সময়ের মধ্য দিয়ে মানুষকে ধরে এনে এখানে…। এটা তো মব জাস্টিস না। চাইলাম, ধরে নিয়ে আনলাম। অথবা ম্যাজিস্ট্রেটরা করে মোবাইল কোর্ট। এটা তো তাৎক্ষণিক বিচারপ্রক্রিয়া না। এটা ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি, জটিলতম অপরাধ, জটিলতম তদন্ত পদ্ধতি, বিচারের পদ্ধতি। সেটাকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী করতে হবে। ছয় বা সাত মাস সময় ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটির জন্য যথেষ্ট না। তারপরও বাংলাদেশের বাস্তবতায়, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী দিনরাত পরিশ্রম করে চার–পাঁচটা মামলার তদন্ত শেষের পথে। এর মধ্যে একটির তদন্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যে পেয়েছি, বাকিগুলো ঈদের পর পাব।’

এদিকে ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে বিক্ষোভ চলার মধ্যে বেলা পৌনে দুইটার দিকে সেখানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন (তামিম)। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে দেওয়া। গ্রেপ্তার করা হলো পুলিশের কাজ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ। তদন্ত করা তদন্তকারী সংস্থার কাজ। আমাদের কাজ হলো তদন্ত শেষে মামলার বিচার করে দেওয়া।’

এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটা প্রসিকিউটর বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গিয়েছি তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়ে। এখন পর্যন্ত দেড় শ জনের বিচার শুরু করা হয়েছে। যেখানে শহীদই হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন। শহীদদের জন্যই আসামি হওয়া উচিত ১৪ হাজার জনের। আহত ২০ হাজারের জন্য আসামি হওয়া উচিত ২ লাখ। একটা আদালতে একজন চিফ প্রসিকিউটর ও ১৪ জন প্রসিকিউটরের অধীনে একটা বেঞ্চে ১৫০টি মামলার বিচার শুরু করা হয়েছে।’

সারা দেশে যদি পুলিশ কাজ না করে তাহলে কি আসামি গ্রেপ্তার করা যাবে—এই প্রশ্ন রেখে প্রসিকিউটর মোনাওয়ার হুসাইন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে পারব? পুলিশ যতক্ষণ পর্যন্ত সক্রিয় না হবে, ততক্ষণ বিচার ত্বরান্বিত করা যাবে না।’ এখন পর্যন্ত একজন আসামিও জামিন পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, ঈদের পরেই পাঁচটি মামলা বিচার পুরোদমে শুরু করা যাবে।

বেলা সোয়া তিনটার পরে একবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালের ফটকে ভেঙে ভেতরে গিয়ে চিফ প্রসিকিউটরের সঙ্গে দেখা করার। তখন তালাবদ্ধ ফটকটি বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ ধাক্কাধাক্কিও করেন। এ সময় সেখানে অবস্থানকারী পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারীদের এমনটা না করতে অনুরোধ করেন। সেই সময় আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেও অনেকে ফটক ভাঙার পক্ষে ছিলেন না। একপর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে কর্মসূচি শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।