প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ভারতে ট্রানজিট/ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার প্রস্তাব পেয়েছে। নির্ধারিত স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ এ সুবিধা নিতে পারে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের শীর্ষ বৈঠকের পর বুধবার প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের পাশাপাশি চলমান সহযোগিতা, অমীমাংসিত বিষয়, ভবিষ্যৎ সহযোগিতা ও নতুন প্রস্তাবের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। দুই পক্ষের অনুরোধ ও প্রত্যাশার বিষয়গুলোও এসেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান এবং আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসঙ্গও এসেছে।
দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তাঁরা এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে বন্ধুত্ব ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যাপকতর সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমায় দুই শীর্ষ নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেন। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন তাঁরা। দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিস্তার রুখতে জোরালো অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
ট্রানজিট/ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত তার ভূখণ্ডের মাধ্যমে বিশেষত স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশে ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য বন্দর অবকাঠামো ব্যবহারে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, সংযুক্তিতে নতুন প্রস্তাব ও উপাদান এবার রয়েছে। বাংলাদেশের কাছে এগুলো নতুন বলে এখনই সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগ নেই।
নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানির জন্য ভারত বাংলাদেশকে বিনা মূল্যে ট্রানজিট দিচ্ছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সদ্য উদ্বোধন হওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটের মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের অনুরোধ করেছে এবং ভারত এর কার্যকারিতা ও সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজি হয়েছে। এ ছাড়া আন্তসীমান্ত রেলসংযোগগুলো কার্যকর করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ক্রসিংয়ে বন্দর বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বাংলাদেশের জন্য বৃহত্তর অর্থনৈতিক অঞ্চলে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের চাহিদা বা প্রত্যাশাগুলো পুরোপুরি পূরণ হয়েছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক বলেন, এই বিবৃতি ধরে দুই পক্ষের মধ্যে অনেক কিছুর আদান-প্রদান হয়ে থাকে। আলোচনা ও দর-কষাকষি হবে। যেমন বছরে কোন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভারত কতটা দেবে, তাতে নিশ্চয় মোটামুটি সন্তুষ্ট। এর চেয়ে বেশি জোরালো অঙ্গীকার থাকে না। এটাকে সহযোগিতার রূপরেখা ধরে নেওয়া যেতে পারে। ভারত বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া না দিলে তো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিষয়ে বিবেচনার আশ্বাস দিত না।
ভারতের কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, যৌথ ঘোষণায় পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, জ্বালানি সরবরাহ এবং সংযুক্তি—এই চারটি আঙ্গিকে দেখলে শীর্ষ বৈঠকের পর যথেষ্ট অগ্রগতি রয়েছে।
তিস্তার গুরুত্ব কি হারিয়ে যাচ্ছে?
ভারতের সঙ্গে আলোচনায় সব সময়ের মতো এবারও পানিসম্পদ বণ্টনে সহযোগিতায় অগ্রাধিকার ছিল। এ ক্ষেত্রে পানিসম্পদ বণ্টনে সহযোগিতার অংশ হিসেবে দুই শীর্ষ নেতা কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টনে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। ত্রিপুরা রাজ্যের সেচের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ফেনী নদীর পানি নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তি সইয়ের জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে ভারত। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা অন্তর্বর্তী চুক্তি সইয়ের রূপরেখা তৈরি এবং তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের লক্ষ্যে বাড়তি কয়েকটি নদী যুক্ত করতে যৌথ নদী কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে গঙ্গার পানির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে যৌথ সমীক্ষার জন্য যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতের আলোচনাগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে তিস্তার অন্তর্বর্তী পানি চুক্তি সইয়ের জন্য বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল ২০১১ সালে।
এরপর ২০১৫, ২০১৭, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালের সব শীর্ষ বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের অবস্থান যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু এবারের যৌথ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা তিস্তার প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি কী বলেছেন, সেটির কোনো উল্লেখ নেই।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি সরবরাহ
ভারত থেকে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত নিজেদের জোগানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচকভাবে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। এ লক্ষ্যে ভারত সব রকম প্রয়াস চালাবে। জ্বালানি সরবরাহের বিষয়ে দুই দেশের নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা করার বিষয়ে একমত হয়েছে ভারত। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে পরিশোধিত জ্বালানি সরবরাহের জন্য ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনকে অনুমোদন দেওয়ার বাংলাদেশি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত।