সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের আট দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। নিউমার্কেট থানা-পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) শুক্রবার এই আদেশ দেন।
জিয়াউল আহসান সর্বশেষ টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক ছিলেন। গত ১৫ বছর আলোচিত ও প্রভাবশালী এই কর্মকর্তাকে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরদিন চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুম ও খুনের ঘটনায় জিয়াউল আহসানকে অন্যতম কুশীলব দাবি করে তিনিসহ জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’।
শুক্রবার জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। বেলা ১টা ৫৪ মিনিটে গণমাধ্যমে ডিএমপির পাঠানো এক খুদে বার্তায় বলা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে বিকেলে সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৬ জুলাই ছয়জন নিহত হন। ওই ঘটনায় নিউমার্কেট থানা-পুলিশ সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা বেশ কিছুসংখ্যক লোকের নাম দিয়ে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় (শাহজাহান আলী হত্যা মামলা) পুলিশ জিয়াউল আহসানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেনা হেফাজতে থাকা মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত জিয়াউল আহসানকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী।
পরে রাত ৮টা ৫৪ মিনিটে ডিএমপি এক সংশোধিত বার্তায় জানায়, জিয়াউল আহসান ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় সেনাবাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করলে ১৫ আগস্ট রাতে তাঁকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নিউমার্কেট থানা-পুলিশ বিকেলে জিয়াউল আহসানকে আদালতে হাজির করে শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে। আর জিয়াউল আহসানের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত জিয়াউল আহসানের আট দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে গ্রেপ্তার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানেরও একই মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন আদালত।
আদালতে শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ খান বলেন, জিয়াউল আহসান ২০১২ সালের পর থেকে এক যুগ ধরে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি আয়নাঘরের (গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখার গোপন বন্দিশালা) জনক। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার ক্রীড়নক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত।
জিয়াউল আহসানের আইনজীবী নাজমুন নাহার বলেন, তাঁর মক্কেল কখনো ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন না। তিনি ‘আয়নাঘর’ বানাননি। ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করা হচ্ছে। শুনানির এক পর্যায়ে জিয়াউল আহসান আদালতকে বলেন, ‘আমাকে ৭ আগস্ট বাসা থেকে নিয়ে গেছে। আমি আয়নাঘরে ছিলাম। আমি কোনো আয়নাঘর বানাইনি।’
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া জিয়াউল আহসান ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে র্যাব-২–এর উপ-অধিনায়ক হন। ওই বছরই তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। পরে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। ২০১৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর কিছুদিন তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৭ সালে তাঁকে এনটিএমসির পরিচালক করা হয়। ২০২২ সালে সংস্থাটিতে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টি করে তাঁকে এনটিএমসির নেতৃত্বে রাখা হয়। ৬ আগস্ট তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর গুম-খুনের বিচারের দাবি আবার জোরেশোরে ওঠে। মায়ের ডাকের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা সরকার আমলে শত শত মানুষকে গুম-খুনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি তোলা হয়।
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াউল আহসানকে শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতসহ প্রতিটা গুম-খুনের গ্রহণযোগ্য তদন্ত করতে হবে। এসব ঘটনায় আরও যাঁরা জড়িত, সবাইকে বিচারের আওতায় আনার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করছেন তাঁরা।