চীনের ঋণে প্রতিশ্রুতির মাত্র ১৪% অর্থ ছাড়
চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তালিকার প্রকল্পগুলো শুধু চীন নয়, দুই পক্ষ বাস্তবায়ন করবে।
সি চিন পিংয়ের সফরে ২৭ প্রকল্পে ২৪০০ কোটি ডলারের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি।
আট প্রকল্পের ঋণচুক্তি সই, ছাড় ৩৩০ কোটি ডলার।
২৭ প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে।
ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে বিশেষ উচ্চতায় নিতে ছয় বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক ওই সফরে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত ২৭টি প্রকল্পে চীন ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তবে চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের পর পেরিয়ে গেছে ছয় বছর। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত চীনের প্রকল্পগুলোর মধ্যে আটটি প্রকল্পের ঋণচুক্তি সই হয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় ৭৮০ কোটি ডলার হলেও এ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। অর্থাৎ চীন প্রতিশ্রুত অর্থের মাত্র ১৪ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। আর ২৭ প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দেন। সংক্ষিপ্ত সফরে গত আগস্টে ওয়াং ই আগস্টে ঢাকায় এসেছিলেন।
সারা বিশ্বে চীন আর্থিক সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা তাদের মোট দেশজ উৎপাদনকে (জিডিপি) ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের প্রতিশ্রুতি আর অর্থ ছাড়ের মধ্যে ফারাকটা বিপুল। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে তাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার পাঠায় না। এখানকার প্রকল্পগুলোর সঙ্গে রাজনীতি ও দুর্নীতির যোগসাজশ থাকে।এম ফাওজুল কবির খান, সাবেক সচিব ও বড় অবকাঠামোবিষয়ক বিশেষজ্ঞ
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ২৭টি প্রকল্পের মধ্যে এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য ছয়টি জাহাজ কেনা, দাসেরকান্দিতে পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প, মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন ও ‘মুরিং’ স্থাপন, বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের উন্নয়ন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তৃতীয় ধাপের উন্নয়ন এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন—এই আট প্রকল্পের জন্য ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। চীন এ পর্যন্ত দিয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার।
বাণিজ্যিক চুক্তি করতেই দুই থেকে আড়াই বছর
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ছয় বছরে চীনা ঋণে যত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাণিজ্যিক চুক্তি করতেই দুই থেকে আড়াই বছর চলে গেছে।
ইআরডি সূত্র জানায়, একটি প্রকল্পে ঋণের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকে প্রস্তাব পাঠানো হলে চীনা কর্তৃপক্ষ প্রথমে প্রকল্পের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুবিধা বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে একজন ঠিকাদারকে বাংলাদেশে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। দুই পক্ষ বসে প্রকল্পের নকশা ও কার্যপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর বাণিজ্যিক চুক্তি হয়। এভাবে পুরো কাজটি করতে দুই থেকে আড়াই বছর চলে যায়।
জানতে চাইলে ঢাকায় চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, তালিকার প্রকল্পগুলো শুধু চীন নয়, দুই পক্ষ বাস্তবায়ন করবে। কিছু চীনের হ্রাসকৃত ঋণে এবং কিছু প্রকল্পের অর্থায়ন হবে অন্য প্রক্রিয়ায়। আবার ওই তালিকার কিছু প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশকে দায়িত্ব নিতে হবে। এ পর্যন্ত ২৭টি প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে অথবা কাজ চলছে। অন্য দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে অর্ধেক প্রকল্প বিবেচনাধীন এবং বাকি অর্ধেক এখনো স্থগিত রয়েছে।
সীমিত পরিসরে দরপত্র প্রক্রিয়া
ইআরডি সূত্র জানায়, এত দিন চীনা ঋণের প্রকল্পে সরাসরি ঠিকাদার কাজ পেত। মূলত কোনো প্রকল্পের জন্য ঋণ প্রস্তাব দিলে চীনা কর্তৃপক্ষই ওই নির্দিষ্ট প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার চূড়ান্ত করে দেয়। ওই ঠিকাদারই কাজটি করে থাকে। দরপত্রের মাধ্যমে বাছাই করে ঠিকাদার নিয়োগের সুযোগ থাকে না।
কয়েক মাস আগে চীনা ঋণের এই নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবে এখন থেকে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে (এলটিএম) ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। এই পদ্ধতিতে দরপত্রে কেবল চীনা ঠিকাদারেরা অংশ নেবেন। ওই দরপত্রে অংশ নেওয়া একাধিক ঠিকাদারের মধ্যে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হবে। এই নিয়ম চালুর পর এখনো কোনো প্রকল্পে এভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়নি।
এ বছর জাহাজ কেনার প্রকল্পে ঋণ
গত অর্থবছরে চীনের সঙ্গে সব মিলিয়ে একটি প্রকল্পে ঋণচুক্তি হয়। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ইআরডি ও চীনের এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি হয়। এই প্রকল্পে চীন ১০০ কোটি ডলার দিচ্ছে। আড়াই বছর ধরে এই প্রকল্পটি নিয়ে চীনের সঙ্গে দেনদরবার হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য ছয়টি জাহাজ কেনার প্রকল্প নিয়ে এখন দর-কষাকষি চলছে। এ বছরেই প্রকল্পটির জন্য ২৫ কোটি ডলার ঋণের বাণিজ্যিক চুক্তি হবে বলে আশা করছেন ইআরডি কর্মকর্তারা। ঋণচুক্তি হলে আগামী চার বছরে এসব জাহাজ আসবে।
ঋণ পরিশোধে সময় কম
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ((ঋণ পরিশোধে বিরতি) ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই প্রকল্পে সব মিলিয়ে ১৯৫ কোটি ডলার দিয়েছে চীন। এই প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি অর্থবছর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ইতিমধ্যে শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার ও তথ্য প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন—এই তিন প্রকল্পে ঋণ পরিশোধে পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ৯০ কোটি ডলারের মতো ঋণ পরিশোধ হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলোর চলতি বছর ও আগামী বছর থেকে শুরু হয়ে আগামী ১০ বছরে সব ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় ঋণদানকারী সংস্থা এবং ইউরোপীয় দেশ থেকে ঋণ নিলে সাধারণত ৩২ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। চীনের ক্ষেত্রে এই ঋণ ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, ঋণের সুদের হার উভয় ক্ষেত্রে প্রায় কাছাকাছি হলেও ঋণ পরিশোধের সময় চীনের চেয়ে অনেক কম। এতে করে চীনের ঋণের বিপরীতে সুদাসল পরিশোধে বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে অর্থনীতির ওপর বড় চাপ তৈরি হয়। বিদেশি ঋণ ব্যবস্থাপনার খরচ তুলনামূলক বেড়ে যায়।
বড় অবকাঠামোবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এম ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, সারা বিশ্বে চীন আর্থিক সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা তাদের মোট দেশজ উৎপাদনকে (জিডিপি) ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের প্রতিশ্রুতি আর অর্থ ছাড়ের মধ্যে ফারাকটা বিপুল। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে তাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার পাঠায় না। এখানকার প্রকল্পগুলোর সঙ্গে রাজনীতি ও দুর্নীতির যোগসাজশ থাকে। শুরুতে তারা কম খরচে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় প্রকল্পগুলোর কাজ নেয়। পরে প্রকল্প সংশোধন করে সময় ও খরচ—দুটিই তারা বাড়িয়ে নেয়।