গণ–অভ্যুত্থানে নিহত অনেককে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে দাফন, পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা কম
রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ১১৪টি মরদেহ। তাঁদের অনেকে গণ–অভ্যুত্থানে নিহত।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ-সংলগ্ন কবরস্থানে প্রতিটি কবরে একটি করে নামফলক আছে। তাতে দাফন করা মরদেহের নাম-পরিচয় লেখা রয়েছে। কিন্তু কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে ওই রকম কোনো নামফলক নেই। একটু পরপর ছোট ছোট বাঁশ পুঁতে রাখা আছে। কেউ বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই যে সেগুলো ‘বেওয়ারিশ’ লাশের কবর।
সারি সারি কবরের দুই পাশে সরু হাঁটাপথ। মাঝখানের জায়গাটি সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে। ফুটেছে ঘাসফুল। সেখানে একটি সাইনবোর্ডে চোখ আটকে গেল। তাতে লেখা, এই কবরগুলোতে যাঁরা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, তাঁদের সবার পিতৃপরিচয় ছিল, ছিল তাঁদের পরিবার। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের কারণে তাঁরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছেন। তাঁরা তো বেওয়ারিশ ছিলেন না। বোঝা গেল, এগুলোর মধ্যে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের কবরও রয়েছে। তাঁদের ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে সেখানে সমাহিত করা হয়েছে।
বেওয়ারিশ লাশগুলো জুলাই-আগস্টে দাফন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, যারা নাম-পরিচয় না জানা মরদেহ দাফন করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, রায়েরবাজার কবরস্থানে তারা জুলাইয়ে ৮০ জনের ও আগস্টে ৩৪ জনের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা অনেকেই আন্দোলনে নিহত। কিন্তু সংখ্যাটি কত, তা অজানা।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম জানিয়েছে, তারা জানুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ে ৫১৫টি মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে। মাসে গড়ে ৪৭টি। তবে জুলাই মাসে সংখ্যাটি বেড়ে ৮০ হয়ে যায়। আগস্টে তারা দাফন করেছে ৩৪টি মরদেহ। যদিও ওই মাসের শুরু থেকে ১১ দিন অস্থিরতার মধ্যে তাদের কাছে কোনো লাশ দাফনের অনুরোধ আসেনি।
টাকা দিয়া কী করুম, আমি ছেলের কবর কোনটা, তা জানতে চাই, দেখতে চাই।
কারা আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিচয় কী—এসব জানতে তদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষা দরকার। কিন্তু সে উদ্যোগের গতি ধীর। ফলে রায়েরবাজারে দাফন করা আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। পরিবারগুলো স্বজনের কবর খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণও পাচ্ছে না।
কেউ কেউ নিজেদের উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন, তাঁদের স্বজনের মরদেহ রায়েরবাজারে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু কবর কোনটি, সেটা জানতে পারছেন না। নিহত ব্যক্তিদের একজন মাহিন মিয়া। মাহিনের ভাই আবদুল জব্বারের সঙ্গে ৯ ডিসেম্বর রায়েরবাজার কবরস্থানে দেখা হয়। তিনি পেশায় রিকশাচালক। তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর ভাই মাহিন গত ১৮ জুলাই মোহাম্মদপুরের টাউন হল এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। মাহিন সেদিন আর বাড়ি ফেরেননি। তার পর থেকে ভাইয়ের খোঁজে আশপাশের থানা, হাসপাতালের মর্গ চষে বেড়িয়েছেন। পরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহের ছবি দেখে জানতে পারেন, তাঁর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে, দাফন করা হয়েছে রায়েরবাজারে। মাহিন মারা যাওয়ার ১৫ দিন পর তাঁর স্ত্রীর প্রথম সন্তান হয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্ত প্রত্যয়নপত্রে মাহিন মিয়ার পরিচয় লেখা আছে ‘অজ্ঞাত’। সেখানে লেখা আছে, ১৯ জুলাই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের স্ট্রেচারে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর মাথার বাঁ ও ডান পাশে ছিদ্র রয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাথায় গুলি উল্লেখ করা হয়েছে।
মাহিনের ভাই আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ের লাশটা চোখে দেখলাম না। এখানে কোনটা আমার ভাইয়ের কবর, তা–ও তো জানি না। ভাইটা বাচ্চার বাপ হইল, এই ছেলে বড় হইলে বাপের কবরটাও চিনব না।’
যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী সোহেল রানার পরিবারও তাঁর নিহত হওয়ার বিষয়টি নিজেদের উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে। স্বজনেরা জানান, তাঁরা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখে ব্যবসায়ী সোহেল রানার মরদেহ শনাক্ত করেন। এরপর স্বজনেরা যান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে। সেখানে গিয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহের নথির মধ্যে সোহেলের ছবি পান। তত দিনে পেরিয়ে গেছে ৩৪ দিন। পরিবার সোহেলের খোঁজ পাচ্ছিল না ১৮ জুলাই থেকে।
সোহেল রানার পরিবার জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছে। তাঁর মা রাশেদা বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকা দিয়া কী করুম, আমি ছেলের কবর কোনটা, তা জানতে চাই, দেখতে চাই।’
চিহ্ন শুধু পুঁতে রাখা বাঁশ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো তৈরি হয়নি। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে নিহত ৮৬০ জনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি ২৮ সেপ্টেম্বর জানায়, তখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী নিহত হয়েছেন মোট ১ হাজার ৫৮১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় তখনই নাম ঢুকবে, যখন আন্দোলনে নিহত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী শহীদুল ইসলাম রায়েরবাজার কবরস্থানের জুলাই ও আগস্টে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহের কবরগুলোর খোঁজখবর রাখেন। ৯ ডিসেম্বর তাঁকে পাওয়া যায় রায়েরবাজারে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি করে বাঁশ, একটি করে লাশ’—এর বাইরে এ কবরগুলো সম্পর্কে আর কিছু জানার উপায় নেই। বৃষ্টিতে কবরগুলো অনেকটা সমান হয়ে গেছে। বাঁশগুলোও পচে যাচ্ছে। একটা সময় পর আর কোনো চিহ্নই থাকবে না।
শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, কবরগুলো সংরক্ষণ করা দরকার, যাতে পরিবারগুলো শনাক্ত করতে পারে। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের আগে থানার জিডি (সাধারণ ডায়েরি) নম্বর বা অন্য কোনো চিহ্ন রেখে যদি কবর দেওয়া হতো, তাহলে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের (শনাক্তকরণ ব্যবস্থা) কাজটাও সহজ হতো। এখন কোনো স্বজন যদি লাশ দাবি করেন, তাহলে সব কটি মরদেহ কবর থেকে তুলে ডিএনএ প্রোফাইল করতে হবে।
রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা ব্যক্তিদের কবরের বয়স দুই বছর হলে সেখানে অন্য আরেকজনকে কবর দেওয়া হয়। বিষয়টি জানিয়ে কবরস্থানের মোহরার (সিটি করপোরেশন থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মোহাম্মদ ফেরদাউস বলেন, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য আলাদা ব্লক আছে, কবরস্থানের নম্বর আছে। তবে কবরগুলো চিহ্নিত করার উপায় নেই। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কাফনের কাপড় পরিয়ে লাশ এখানে আনার পর জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
উদ্যোগ কী
আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে ‘গণ–অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করেছে সরকার। ১০ নভেম্বর এই সেলের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে নিহত, নিখোঁজ, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত অথবা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে অন্য কোনোভাবে মারা গেছেন, তাঁদের স্বজনদের তালিকায় নাম লেখাতে অনুরোধ জানানো হয়। থাকতে হবে নিহত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মনিবন্ধন সনদ, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা এবং উপযুক্ত প্রমাণ।
সেলে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া অথবা নিখেঁজ কোনো ব্যক্তির নাম জমা পড়েছে কি না, তা জানতে চাইলে সেলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত সেলে সেভাবে আবেদন জমা পড়েনি। জেলা পর্যায় থেকেও তেমন কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। তিনি আরও জানান, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছ থেকে তাঁরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা ব্যক্তিদের তালিকা, নথিপত্র ও ছবি সংগ্রহ করেছেন।
রাজধানীর কাকরাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে ঢুকতেই (১০ ডিসেম্বর) একটি ছবির বোর্ড দেখা গেল। জুলাই-আগস্টে বেওয়ারিশ হিসেবে যাঁদের দাফন করা হয়েছে, সেগুলো তাঁদের ছবি। সংস্থাটি ছবির পাশাপাশি থানা ও হাসপাতাল থেকে পাঠানো জিডি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ নানা নথি সংরক্ষণ করছে। কিন্তু নিহত ব্যক্তিদের শনাক্তে স্বজন হারানো পরিবারের খোঁজ দরকার এবং ডিএনএ পরীক্ষা দরকার।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই-আগস্টে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া কতজন আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছেন, তা বলা সম্ভব নয়। বেওয়ারিশ লাশের কবরে আলাদা করে কোনো চিহ্ন বা পরিচয় শনাক্তকারী কোনো কিছু থাকে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষা করতে লাশ উত্তোলন করতে আদালতের নির্দেশ লাগবে। পুরো প্রক্রিয়ায় দরকার সরকারের জোরালো উদ্যোগ।
নিহত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা করা হলে সেটির দায়িত্ব পড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ‘ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি’র ওপর। এই পরীক্ষাগারের প্রধান ও ডেপুটি চিফ ডিএনএ অ্যানালিস্ট আহমাদ ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীর চারটি এবং সিরাজগঞ্জের দুটি পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের ডিএনএ প্রোফাইল করার আবেদন তাঁরা পেয়েছেন। দুটি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। অন্যগুলোর দাবিদার আসেননি।
আহমাদ ফেরদৌস বলেন, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশগুলো কবর থেকে তুলে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করতে হবে। কাজটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। তবে সরকার নির্দেশ দিলে তা করা সম্ভব।
অবশ্য কোনো কোনো পরিবার এখনো স্বজনকে খুঁজছে। এর মধ্যে রয়েছেন রূপনগর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মারুফের মা মৌসুমী আক্তার। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম থেকে তাঁর নামটি জানা যায়। মৌসুমী প্রথম আলোকে বলেন, ২১ জুলাই সকালে ঘর থেকে বের হয় মারুফ। তার পর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে বেকারির কাজ হারিয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি তো মা, আমি কী কইরা বলমু আমার ছেলে নাই। কিন্তু ছেলে তো আর আসে না।’
‘সরকার দেরি করে ফেলেছে’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সাড়ে চার মাস পেরিয়ে গেলেও রায়েরবাজারে বেওয়ারিশ পরিচয়ে দাফন করা মরদেহগুলো শনাক্তে জোরালো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে গিয়ে নিখোঁজ বা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তে সরকার অনেক দেরি করে ফেলেছে। অনেক পরিবার এখনো জানেই না তাদের স্বজন বেঁচে আছে না মারা গেছে। সরকার একটি সেল গঠন এবং বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও তা কতজনের চোখে পড়েছে, সেটাই প্রশ্ন। তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তি প্রচার এমনভাবে করতে হবে, যাতে তা সবার চোখে পড়ে। ডিএনএ পরীক্ষাসহ যত জটিলতাই থাকুক, আন্দোলনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করতেই হবে।