জাহাঙ্গীরনগরে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের সংস্কারসহ ৬ দাবিতে ছাত্রীদের মশালমিছিল

মশালমিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশ করেন নারী শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাঁদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকও অংশ নেন।

যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সান্ধ্য আইন প্রয়োগ করে নারী শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা নির্ধারণ বন্ধসহ ছয় দাবিতে মশালমিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের সামনে থেকে ‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা রাত দখল করো’-এর ব্যানারে মিছিলটি বের করা হয়।

ভারতের কলকাতায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে করা মশালমিছিলটি কয়েকটি সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাঁদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন নারী শিক্ষকও অংশ নেন। সমাবেশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে জারি করা সান্ধ্য আইন অমান্য করে নতুন কলাভবনে সিনেমা প্রদর্শন করেন তাঁরা।

শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা প্রসঙ্গে একাডেমিক ও পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ এবং সেলের প্রয়োজনীয় সংস্কার; হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে আসা অভিযোগের নিষ্পত্তি, প্রতিটি একাডেমিক ভবনে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেট নিশ্চিত এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্তসংখ্যক পাবলিক টয়লেট স্থাপন; প্রতিটি হলে ও বিভাগে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ; নিরাপত্তা ও রাতের অজুহাতে নারীদের হলের ছাদ, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আড্ডার স্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় নারীদের বিচরণ সীমিত করার প্রচেষ্টা বন্ধ।

এই আমরা সবাই অনেক বড় একটা স্বর। যদি আমরা ভাবি ওই মেয়ের পাশে দাঁড়াব না, তখন আমরা সবাই দুর্বল হয়ে পড়ব। ধর্ষণের জন্য শরীর লাগে না, শরীর দেখে ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ করা হয় ক্ষমতা-সম্পর্ক জায়েজ করার জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, মেয়ে মানুষের জন্ম শুধু বিনোদনের জন্য নয়; মেয়ে মানুষ শুধু শরীর আর সৌন্দর্যের জন্য নয়। কোনো মেয়ের জন্ম শুধু জন্মদানের জন্য নয়, কোনো মেয়েই পুরুষের তুলনায় কম নয়
রেজওয়ানা করিম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

সমাবেশটিতে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসীর সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান। সুমাইয়া বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটির কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। এই সেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, যেসব ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী সেখানে অভিযোগ করেন, উল্টো তাঁদেরই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোয় যদি এত বড় ছিদ্র থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ আরও বিশাল। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অসংখ্য নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। একজন নারী হিসেবে জন্ম নেওয়ার ফলে আমাদের যে ধরনের সহিংসতার শিকার হতে হয়, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা চাই, মেয়েদের প্রতি সব বৈষম্য ও সহিংসতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশের জন্য একটি উদাহরণস্বরূপ বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা। তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রায়ই ধর্ষক মানিককে নিয়ে কথা শোনা যায়, কিন্তু কেউই জানতে পারেনি যে আসলে কাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। প্রশাসন থেকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আসলে কাকে ধর্ষণ করা হয়েছে”; তখন জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা বলেছিল, “আমাদের সবাইকে ধর্ষণ করা হয়েছে।”’

সেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, যেসব ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী সেখানে অভিযোগ করেন, উল্টো তাঁদেরই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোয় যদি এত বড় ছিদ্র থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ আরও বিশাল।
সুমাইয়া জাহান, শিক্ষার্থী

রেজওয়ানা করিম আরও যোগ করেন, ‘এই আমরা সবাই অনেক বড় একটা স্বর। যদি আমরা ভাবি ওই মেয়ের পাশে দাঁড়াব না, তখন আমরা সবাই দুর্বল হয়ে পড়ব। ধর্ষণের জন্য শরীর লাগে না, শরীর দেখে ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ করা হয় ক্ষমতা-সম্পর্ক জায়েজ করার জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, মেয়ে মানুষের জন্ম শুধু বিনোদনের জন্য নয়; মেয়ে মানুষ শুধু শরীর আর সৌন্দর্যের জন্য নয়। কোনো মেয়ের জন্ম শুধু জন্মদানের জন্য নয়, কোনো মেয়েই পুরুষের তুলনায় কম নয়—এটা আমাদের সবার মনে রাখতে হবে।’