একুশের মহাফেজখানা

১৯৬০ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ প্রতিবছরই বের করেছে একুশে সংকলন। সেসব সাময়িকীপত্রে লিখেছেন ও এঁকেছেন কালজয়ী শিল্পী–কবি ও সাহিত্যিকেরা। অতীতের সেসব লেখার কিছু এই সমকালে। মতিউর রহমান সম্পাদিত ও প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী বর্ণমালা’ বই থেকে সংকলিত।

প্রবন্ধ

এমনি করেই গড়ে উঠবে

ভয়, আশঙ্কা আর অন্ধকার—এই তিনে মিলে রাতটা কেমন ভয়ংকর।

অন্ধকারটা বুঝি আরও ভয়ংকর। সেখানে গা ঢাকা দিয়ে আছে হায়েনার দল, ওত পেতে আছে হিংস্র নখর মেলে। যেকোনো মুহূর্তে অন্ধকারের গা থেকে নেমে আসবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে।

এমন রাত কমই আসে মানুষের জীবনে। যে রাত ইতিহাস সৃষ্টি করে, যে রাতের গর্ভ থেকে ইতিহাস জন্ম নেয়, ইতিহাস কথা কয়ে ওঠে, যে রাত্রে কেউ ঘুমিয়ে থাকতে পারে না, যে রাত্রি জীবনকে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় সত্যের মুখোমুখি, যে রাত্রি অতি বড় স্বার্থপরকেও ত্যাগের প্রেরণা দেয়, এ তেমনই এক রাত্রি।

পিঁপড়ের সারির মতো এদিক-ওদিক পিলপিল করছে ওরা। ওরা ছাত্রছাত্রী আর কর্মী, ওদের মুখে কথা কম, পিঁপড়ের মতোই নিঃশব্দ পায়ে চলছে ওরা।

ডাক্তার নাকি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে না, সাহিত্যের ছাত্র হতে পারে না রাজমিস্ত্রি। কেমিস্ট্রির কৃতী ছাত্র কেমন করে আর্কিটেক্ট হয়? বইয়ের পোকা কেমন করে ইনকিলাবের কথা বলে? কিন্তু আজকের রাত্রে সবাই সবকিছু হতে পারে, হয়েছে। আজকের রাত্রি তো অসম্ভবের উন্মোচন।

পরিকল্পনাটা প্রথমে কার মাথায় এসেছিল, সে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। নকশাটা কেমন সেটাও ওরা দেখেনি, দেখবার কোনো বিশেষ ইচ্ছে বা তাগিদও নেই ওদের। ওরা শুধু জানে একটা মিনার গড়ে তুলতে হবে এবং এই এক রাতের মধ্যেই ভোর হবার আগেই।

বাতি জ্বলে উঠল। ব্যারাকের কামরায় কামরায় আর উঁচু থামগুলোর মাথায় মাথায়। তখন দেখা গেল। দেখা গেল ওরা অনেক। দু শ, পাঁচ শ অথবা তারও বেশি। ওরা একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়েছে। এভাবে লম্বা লাইন, পাঁচ শ গজ কি সাত শ গজ। হাতে হাতে ইট আসছে। এক হাত থেকে আর এক হাতে চালান হয়ে চার কি পাঁচ শ হাত ঘুরে একটা ইট এসে পৌঁছাচ্ছে অকুস্থলে, যেখানে দুহাত পরিমাণ মাটিতে রক্ত জমাট হয়ে আছে। এখানেই শহীদ মিনার গড়ে উঠবে।

এমনি করে ইটগুলো আসছে। কোনোটা রাস্তার ওপারে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে, কোনোটা মেডিকেল কলেজের ভেতরে যেখানে নতুন ইমারত তৈরি হচ্ছে সেখান থেকে।

যেমন হঠাৎ করে আলো জ্বলেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই নিভে গেল। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ধুত শালা।

বিজলি কোম্পানিটাও যেন আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে, আর একজন সখেদে বলল।

কিন্তু কাজ থামল না। ওদের চোখে এখন যে দৃঢ়তা ও সংকল্পের জ্যোতি, তা সকল অন্ধকারকেই দূর করেছে।

ঘাঁটি তোলা হয়ে গেছে। এখন সেখানে ইট পড়ছে। ভিত গড়ে উঠছে। একটি একটি করে ইটের স্তূপ জমে উঠেছে। আর সেই শব্দ কানি, ছেনি, হাতুড়ি আর সিমেন্ট ঘষার যে শব্দ। সেই শব্দও দ্রুততর হচ্ছে। শীতের শেষ হলেও মোটামুটি শীত পড়ছে। পড়ছে কিন্তু ওরা সবাই ঘামছে।

একটি মেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। অমনি চেঁচিয়ে উঠল হয়তো তারই সহপাঠী ছেলেটা, আগেই বলেছি যার যেটা কাজ, মেয়েমানুষ দিয়ে এসব কাজ হবে না। এখন বুঝলে তো? দয়া করে সরবে কি?

সরবে না হাতি! একলা নয়, আরও দু-তিনজন মেয়েবন্ধুকে নিয়ে মুখিয়ে উঠল মেয়েটা।

উইথড্র উইথড্র, কোনো একজন মেয়ে রীতিমতো চিল্লিয়ে উঠল।

তা নয় উইথড্র করলাম, কিন্তু এ নিয়ে তৃতীয় কি চতুর্থবার পতন, আর কতবার পতন হবে শুনি?

মোটেই না মোটেই না, এ নিয়ে মাত্র দুইবার। সমস্বরে প্রতিবাদ করল মেয়েরা। বাতি আর জ্বলল না, কিন্তু শেষ রাতের চাঁদটা একটু উঁকি মারল। তাতেই দেখা গেল মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

আরও তাড়াতাড়ি। আরও তাড়াতাড়ি। কাজও বিশেষ নেই, রাতও বিশেষ নেই। কয়েক সহস্র হাত উদ্দাম হয়ে উঠল।

তারপর শেষ রাত্রির নিঃশব্দটা ভেঙে টুকরো টুকরো হলো অজস্র কণ্ঠের আনন্দিত স্লোগানে। মিনার তৈরি হয়ে গেছে। মিনার তৈরি হয়ে গেছে। শহীদস্মৃতি অমর হোক।

এমনি করেই গড়ে উঠবে আদর্শের মিনার। এমনি করেই অজস্র হৃদয়ের অর্ঘ্যে, অসংখ্য হাতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায়, ত্যাগে-মহিমায়, দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় পরিপুষ্ট হয়ে গড়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ।

শহীদুল্লা কায়সার

শহীদুল্লা কায়সার (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক; প্রগতিশীল লেখক। লেখাটি ছাপা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিধ্বনি পত্রিকায়, ১৯৬৪ সালে।

প্রবন্ধ: একুশে ফেব্রুয়ারি

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। সে শুধু অবাধ, শুধু আবেগজাত নয়—যুক্তি ও বিচারের মাপকাঠিতেও তার তারতম্য হয়।

বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার কর্মসূচি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির একমাত্র লক্ষ্য। এমন কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের একটি দিন একটি জাতির ইতিহাসে যুগান্তরের কাল বলে বিবেচিত হলো কেন? তার কারণ এই, ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত ছিল কতগুলো মূলনীতির প্রশ্ন। সেই মূলনীতিগুলোই আমাদের জাতীয় জীবনে তরঙ্গ তুলছে বারবার, প্রশ্ন তুলেছে, সমাধান খুঁজেছে, মীমাংসা পেয়েছে।

ভাষাগত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তার সঙ্গে তাই জড়িত ছিল সাংস্কৃতিক চেতনা, রাজনৈতিক আদর্শ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রবৃত্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাই কর্মসূচি অতিক্রম করে এ আন্দোলনকে বিশিষ্ট গৌরব দান করেছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি একই সঙ্গে সংস্কৃতিচেতনার প্রকাশ ও বিকাশের দিন। তাই ১৯৫২ সালের পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যেকোনো চক্রান্তই ব্যর্থ হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য আরবি ও রোমান হরফের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, হরফ সংস্কারের প্রচেষ্টাও সাধারণের সমর্থন পায়নি। অন্যদিকে সংস্কৃতিক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে দেশবাসী সচেতন হয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে এই সদা জাগ্রত মনোভাবই রবীন্দ্রবিরোধী সকল কর্মকৌশলকে পযু‌র্দস্ত করেছে।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ ভূমিকা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দলগত সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ না করেও বলা যায় যে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জনসাধারণের সর্বসম্মত দাবি ছিল। এই সঙ্গে অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিও দেখা দিয়েছে। তা-ও হলো ১৯৫২ সালের চেতনার ফল।

অবশ্য এ কথা স্মরণ রাখা দরকার, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের মূলে যা ক্রিয়াশীল ছিল, তা শুধু সাংস্কৃতিক চেতনা নয়, রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও অর্থনৈতিক হতাশা। এ জন্যই ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন নিতান্ত সীমাবদ্ধ ছিল, ১৯৫২ সালে তা অমন সর্বব্যাপী হতে পেরেছিল।

কিন্তু এ কথাও সত্য যে একুশে ফেব্রুয়ারিই সেই চেতনা, বিক্ষোভ ও হতাশাকে একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ দিয়েছিল। এদিনের পরীক্ষায় উন্নীত হবার পরই ব্যাকুল জিজ্ঞাসা, অস্পষ্ট উপলব্ধি ও সচেতন দাবিদাওয়া একটা সুস্পষ্টরূপ লাভ করেছিল, জমাট বেঁধেছিল। জনসাধারণের শক্তির পরিচয় যেমন সেদিন পাওয়া গিয়েছিল, তেমনি আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিল সকলের মনে। নেতাদের দ্বিধা ও জড়তাকে পায়ে দলে জনসাধারণ অগ্রসর হয়েছিল সেদিন এবং জেনেছিল যে
অধিকার অর্জনের অনন্ত সম্ভাবনা তার মধ্যেই নিহিত ছিল।

১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এসব কথা নতুন করে মনে পড়ছে। সেই অনন্ত সম্ভাবনাকে দেশের মানুষ আবার কাজে লাগিয়েছে। নেতৃত্বের দ্বিধা, জড়তা ও অনৈক্যকে পশ্চাতে ফেলে দেশবাসী আবার এগিয়ে গেছে। যে মানুষের ভাষার অধিকার দাবি করে একুশে ফেব্রুয়ারি দেখা দিয়েছিল ১৯৫২ সালে, এখন সেই মানুষের অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম সূচিত হয়েছে। সেই আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি—ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে আবার দেখা দিয়েছে। এ সংগ্রামের ব্যাপকতা ও বিস্তার বিস্ময়কর। জনশক্তির এই প্রচণ্ড অভ্যুত্থান, তার সর্বব্যাপী চেতনা, তার সংগ্রামী চরিত্র—এসবের বিশ্লেষণে এ কথা মনে না হয়ে পারে না যে এই আন্দোলনের মূল নিহিত ছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেই। ১৭ বছরে তা ব্যাপক, বিস্তৃত ও সর্বপরিপ্লাবী হয়েছে। কিন্তু এর মূলনীতি রচিত হয়েছিল সেই কালান্তরের দিনে।

এ জন্যই মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের দিন নয়—তা আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দিন, আত্মসাক্ষাৎকারের দিন, আত্মবিশ্বাসের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শুভসূচনার দিন, জনশক্তির বিজয়যাত্রার দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিস্মরণীয় রক্তবর্ণ দিন।

আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী; জাতীয় অধ্যাপক। লেখাটি ছাপা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের নিনাদ পত্রিকায়, ১৯৬৯ সালে।

কথাচিত্র: হোসেনের মা

বাজারের কাছে এসে নদীটা যেখানে একটা বাঁক নিয়েছে, তারই ওপর শ্মশানঘাট। আমরা চারজন এসে ঘাটের কাছে দাঁড়ালেম। গভীর রাত্রি। অন্ধকারের তলে তলে রাত্রির ধারা নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। কালিমায় চারদিক সব একাকার হয়ে গেছে। শুধু নদীর বুকে দূরে দূরে নৌকোগুলোতে কেরোসিনের বাতি এই বিসর্পিত অন্ধকারের মধ্যে রহস্যময় ইঙ্গিতের মতো জ্বলছে। কলকল ছলছল জলের শব্দ।

বাজারের পাশ দিয়ে নদীর ধারে যে রাস্তাটা গেছে, তারই প্রান্তে ছোট্ট একটা চালাঘরের ভেতর থেকে একটু আলো দেখা যায়। একটু এগিয়ে গিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেম। জীর্ণশীর্ণ দেহ এক খোট্টা দেশীয় বৃদ্ধ কতকগুলো ময়লা-ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘরের মেঝেয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আর তারই পাশে বসে এক যুবতী শিলনোড়া দিয়ে ডাল পিষছে। সামনে একটা মাটির শানকিতে পেঁয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা কুচানো রয়েছে। টিমটিম করে কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। ব্যাপারটা বুঝতে একমুহূর্তও দেরি হলো না। মেয়েটির নিটোল দেহ। কালো পাথরে গড়া মূর্তির মতো। মাথার বেণিটি ঘাড়ের ওপর দিয়ে সামনে এনে দিয়েছে। আর গিরিবর্ত্মের ওপর পার্বত্য নদীর মতো সে বেণি ওর বুকের মাঝখান দিয়ে নেমে পড়েছে। গভীর নিশীথে নদীতীরের এই নির্জনতায় দাম্পত্য জীবনের এই ছবি দেখে আমার চোখে জল এল।

অভিভূত হয়ে ভাবছিলেম, এমন সময় হঠাৎ মঞ্জু পেছন থেকে ডেকে উঠল—শিগগির চলে এসো দাদা, নৌকো এসে গেছে।

নিঃশব্দে আমরা চারজনই নৌকোয় উঠে পড়েছি। আমি, মঞ্জু, সফি আর আহাদ। নৌকো আমাদের আগেই ঠিক ছিল।—১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে আমাদের চারজনের নামেই পুলিশ হুলিয়া বের করেছে, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু ক্ষুধিত কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি ওদের। অন্ধকারেও আত্মগোপনের পথ নেই, ছায়ার মতো পেছনে পেছনে অনুসরণ করেছে। ঢাকা শহর ছেড়ে তাই সফিদের গ্রামে নদীর ওপারে আশ্রয় নেব ঠিক করেছি। ওপারে উঠে নীরবে পথ চলতে লাগলেম। অন্ধকারে সরু পায়ে হাঁটা মেঠো পথটি অস্পষ্ট দেখা যায়। অদূরে দুপাশের ধানখেতের ওপর শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দ শোনা যায়।

সামনের গ্রামটি পেরিয়ে একফালি মাঠের মধ্যে এসে পড়লেম। হঠাৎ পেছনে অনেক লোকের পায়ের শব্দ শুনে আমরা চকিত হয়ে উঠেছি। ফিসফিস করে সফি বলে উঠল—শালারা টের পেয়েছে, খুব সাবধান।

কথা বলেই আমাদের টেনে নিয়ে মাঠের পাশে একটা তালপাতার ছাউনি দেওয়া ভাঙা কুঁড়েঘরের মধ্যে ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ল। আমরাও ওর সঙ্গে ঢুকে পড়েছি। ঘরে ঢুকতেই এক বুড়ি ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে চিৎকার করে উঠল—ও রে বাবা রে...ডাকাত পড়েছে রে... ডাকাত...ওরে বাবা রে, গেলুম রে...।

একলাফে সফি বুড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর মুখে হাত চেপে ধরলে। বললে—এই পাগলি চুপ চুপ—আমি রে—আমি সফি—চুপ কর শিগগির— পুলিশ আসছে।

পুলিশের কথা শুনে বুড়ি হঠাৎ চুপ করে গেল। দেখলেম, বুড়ি সফিকে চেনে।

ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেম, সাদা কাপড় পরা কয়েকজন লোক পথ দিয়ে যাচ্ছে। বোধ হয়, গাঁয়ের লোক। কোনো কারণে শহর থেকে রাত করে ফিরছে। দেখে খানিকটা নিশ্চিত হওয়া গেল...কিন্তু কিছুদূরে পেছনে আবার পায়ের শব্দ শোনা যায়। ইতিমধ্যে পাগলি আবার চিৎকার শুরু করেছে।—তোরা কী করেছিস...তোদের আমি ধরিয়ে দেব...ধরিয়ে দেব শয়তানের দল সব।

স্বল্পান্ধকারে এগিয়ে পাগলির চেহারা দেখেই চমকে উঠলেম। চুলগুলো শণের মতো সাদা, পিঙ্গল চোখ কোটরাগত। চামড়া কুঁচকে গেছে, শরীরে মাংস নেই। ডাইনির মতো মনে হয়। দয়ামায়ার লেশমাত্র কোথাও নেই। পাগলি হোসেনের মা বলেই গাঁয়ে পরিচিত। ওর একমাত্র ছেলে হোসেন শহরে রেলের কারখানায় কাজ করত। কারখানায় ধর্মঘটের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায়। এর পর থেকেই বুড়ি প্রায় পাগল হয়ে গেছে। শাকপাতা কুড়িয়ে, ভিক্ষে করে বুড়ির দিন কাটে।

হঠাৎ আহাদ এক কাণ্ড করলে। ঘরের এক কোণে একটা সাজিতে কিছু মুড়ি ছিল, তা-ই বের করে খেতে শুরু করেছে। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় সবাই কাতর। চারজনেই খেতে লেগে গেছি, আর বুড়ি তো অগ্নিমূর্তি হয়ে চিৎকার করছে—আমার সব খেয়ে ফেললে রে...হারামজাদা শয়তানের দল...তোদের আমি ধরিয়ে দেব...ধরিয়ে দেব।

মাটির কলসি থেকে জল ভরতে গিয়ে মঞ্জু ঘরের মাঝখানে কলসিটা ভেঙে ফেললে। তেষ্টায় বুক ফেটে যায়, তবু জল আর কারও খাওয়া হলো না। পাগলির অবস্থা তখন কল্পনা করা যায় না। মরিয়া হয়ে চিৎকার করছে—আমি তোদের ধরিয়ে দেব...ধরিয়ে দেব।

ইতিমধ্যে বাইরের পায়ের শব্দ অনেকটা কাছে চলে এসেছে। মধ্যে বুড়ি—অদূরে রাস্তায় পুলিশের লোক। ধরা না দিয়ে কোনো উপায় নেই। শ্বাসরুদ্ধ করে ঘরের কোণে অন্ধকারে চারজনেই দাঁড়িয়ে আছি। নিজেদের অত্যন্ত অসহায় বলে মনে হলো।

হঠাৎ পাগলি বাইরে গেল। ...এবার ও পুলিশের দল নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে। প্রতিমুহূর্তেই আশঙ্কায় কাঁপছি। হায় রে, ধরা পড়তেই হবে। ...কিছুক্ষণ কেটে গেল। ওরা ভেতরে এল না। ব্যাপার কী, দরজার কাছে এগিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, বুড়ি একা পথের ওপর দাঁড়িয়ে। পুলিশের লোক বোধ হয় আত্মগোপন করে আছে।

ঘরের মধ্যে তিনজনকে রেখে আমি একা ধীরে ধীরে চলে এসেছি। পেছন থেকে বুড়ির কাছে আসতেই দেখলেম, ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী বিড়বিড় করছে। কথাগুলো অস্পষ্ট কানে এল—আল্লা, আমার কসুর তুমি মাপ করো—আমি মিথ্যে বলেছি—আমি ভুল পথ দেখিয়ে দিয়েছি। আমার হোসেন পুলিশের গুলিতে গেছে আল্লা—ওদের আমি ধরিয়ে দিতে পারিনি। তুমি মাপ করো, মাপ করো আল্লা।

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেম। ভোর হয়নি তখনো। শুধু কাজল পাখির বুকের মতো কোমল আলোর একটা আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেব্রুয়ারি শেষের আকাশ থেকে শিশির ঝরে ঝরে সামনের ঘাসে ঢাকা মাঠটি একেবারে ভিজে গেছে।

অজিত কুমার গুহ

অজিত কুমার গুহ (১৫ এপ্রিল ১৯১৪—১২ নভেম্বর ১৯৬৯)। প্রগতিশীল লেখক; ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেপ্তার হন। লেখাটি ছাপা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত অরণি পত্রিকায়, ১৯৬৮ সালে।

কবিতা: একুশের গান

হবে হবে জয় তোমাদের হবে জয়

তোমাদের খুনে রঙিন হইয়া জনমিবে বরাভয়।

               রাজভয় আর রাজ কারাগার,

               যুগে যুগে যার খুলে দিল দ্বার,

ফাঁসির মঞ্চ ঘোষিল যাহার অমরতা অক্ষয়।

                অস্ত্র যাহারে ছেদন করেনি,

                বহ্নি দহনে যেজন দহেনি,

সেই শাশ্বত প্রাণ-প্রবাহিনী দিগন্তে মহা-উদয়।

                জবাকুসুমের দ্যুতি মনোরম,

                জাগিছে প্রভাত উজ্জ্বলতম,

চরণে দলিত মহানির্মম আঁধার লভিছে ক্ষয়।

                ভয় নাই, নাহি ভয়।।

জসীমউদ্‌দীন

জসীমউদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১৪ মার্চ ১৯৭৬)। কবি। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের বজ্রে বাজে বাঁশী সংকলনে, ১৯৬৯ সালে।কবিতা:

কবিতা: কারফিউ

 কারফিউ রে কারফিউ

                দুয়ার খোলে কে

রাঙাবরণ ছেলেরা লাল

                নিশান তুলেছে,

লাল মোরগের পাখার ঝাপট

                বাজল খোঁয়াড়ে

উটকোমুখো সান্ত্রি বেটা

                হাঁটছে দুয়ারে।

খড়খড়িতে চোখ রেখে কে

                বেড়াল ডাকে মিউ

খোকন সোনার ভেংচি খেয়ে

                পালাল কারফিউ।

আল মাহমুদ

আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬—১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। কবি। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের একুশের স্মরণে সংকলনে, ১৯৭০ সালে।কবিতা:

 কবিতা: শহীদ মিনার

 শহীদ মিনার আজও তার

শ্বেতশুভ্র বক্ষ অন্তরাল রেখেছে করিয়া লালে লাল।

শোণিতাক্ত পঞ্জরে পঞ্জরে আজও রক্ত ঝরে,

আজও রমনার লাল ফুল অশোক শিমুল

রক্ত ঝরে পথের ওপর ঝরে ঝর ঝর। ঝরা পাতায় উদাস

হাওয়ায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া বহে যায়

বহে দীর্ঘশ্বাস জননীর।

মূকের ফুটেছে ভাষা, ভীরু কণ্ঠে বেজে ওঠে গান

শহীদ মিনারে পেল মানুষ পথের সন্ধান।

সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১—২০ নভেম্বর ১৯৯৯)। কবি; প্রগতিশীল আন্দোলনের নেত্রী। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের একুশে স্মরণে সংকলনে, ১৯৭০ সালে।

কবিতা:  আমরা কথা বলছি

 অনেকগুলো তারার মধ্যে

                একাকী উজ্জ্বল একটি তারা।

শান্তির প্রচ্ছায়ে আলোর শিখার মতো

                নয়া বন্ধুত্বের প্রারম্ভ।

নতুন পথের ইশারায়

                উত্তীর্ণ হলো কাব্যগাথা

আমাদের মনে এল অনেক কথা

আমরা কথা বলছি।

শহীদ সাবের

শহীদ সাবের (১৮ ডিসেম্বর ১৯৩০—৩১ মার্চ, ১৯৭১)। সাংবাদিক; কবি; কথাসাহিত্যিক। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ দৈনিক সংবাদ–এর কার্যালয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের একুশে স্মরণে সংকলনে, ১৯৭০ সালে।

কবিতা: পুলিশ রিপোর্ট

এত উজ্জ্বলতা আমি কখনো দেখিনি।

সবখানে জ্বলজ্বলে ঝোপ; এত উজ্জ্বলতা, চোখ-অন্ধ-করা,

                                                                     চৈতন্য-ধাঁধানো

 উজ্জ্বলতা দেখেননি মুসাও কখনো।

মুঠোয় বাগিয়ে লাঠি দেখলাম ওরা, সংখ্যাহীন

জ্বলজ্বলে ঝোপঝাড় এগোয় কেবলি। চতুর্দিকে তরঙ্গিত মাথা,

                                                                   উত্তাল, উদ্দাম।

 সড়কের দুকূল-ছাপানো

                        লোক, শুধু লোক।

 লোক,

আমাদের চোখের পাতায়

                         লোক।

 লোক,

পাঁজরের প্রতিটি সিঁড়িতে

                         লোক।

 লোক,

ধুকপুকে বুকের স্কোয়ারে

                         লোক।

হঠাৎ সে কোন তরুণের বুকের গভীর থেকে

কী যেন ফিনকি দিয়ে ছোটে, পড়ে আমার দুহাতে।

রক্ত এত লাল আর এমন গরম

কখনো জানিনি আগে। ব্যারাকে পৌঁছেই ঘন ঘন

ধুই হাত ঘষে ঘষে,

                      অথচ মোছে না দাগ কিছুতেই সে তাজা রক্তের।

হোসপাইপের অজস্রতা পারে না মুছতে দাগ,

এ দাগ ফেলবে মুছে এত পানি ধরে না সমুদ্রে কোনো দিন।

ঘড়িতে গভীর রাত, ব্যারাক নিশ্চুপ। বারান্দায়

করি পায়চারি আর হঠাৎ কখনো কানে ভেসে আসে

                                                    সমুদ্রের বিপুল গর্জন;

সুন্দরবনের সব প্রজ্বলন্ত বাঘ যেন আমার ওপর

                                   পড়বে ঝাঁপিয়ে ক্ষমাহীন।

 ঘুমোতে পারি না আমি কিছুতেই, ঘুমকে করেছি গুম-খুন।

কেমন উৎকট গন্ধ লেগে রয় সকল সময়

আমার দুহাতে আর সমস্ত শহরে।

সারাটা শহর যদি কেউ দিত ঢেকে

অজস্র সুগন্ধি ফুলে তবে দুটি হাত গোপনে লুকিয়ে

রাখতাম সুরভিত ফুলের কবরে সর্বদাই।

শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৮ আগস্ট ২০০৬)। কবি। কবিতাটি প্রকাশিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নিনাদ সংকলনে, ১৯৬৯ সালে।