নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক

১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ডিসেম্বর মাসে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বিজয়ের এই মাসে আমরা হাজির করছি তারিখ ধরে ধরে সেই দিনগুলোর ঘটনাধারা। ঈষৎ সংক্ষেপ করে লেখাটি নেওয়া হয়েছে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিতব্য বই একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি থেকে।

জগজিৎ সিং অরোরা

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকতে ৪ নভেম্বর উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশ জরুরি বৈঠক ডাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পরিষদের সভাপতি সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রদূত ইসমাইল টেলর কামারার হাতে চিঠি দেয়। চিঠিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া ও সোমালিয়া। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পরিষদের সভাপতির কাছে বৈঠকের শুরুতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বক্তব্য পেশ করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

ডেনমার্ক সফররত সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ সংঘর্ষ এড়াতে তাঁরা সাধ্যমতো সব চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ববঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করেই এ সংকট ডেকে আনা হয়েছে। ডেনিশ সংবাদ সংস্থা তাঁর এক সফরসঙ্গীর মন্তব্য উদ্ধৃত করে জানায়, এ যুদ্ধে এখনই হস্তক্ষেপ করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করে না।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণই লক্ষ্য

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণই তাঁদের লক্ষ্য। ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার স্থাপনে সহায়তা করতে চায়।

দিল্লিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষ রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিশেষ অধিবেশনে জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছে। তারা বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তারা শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বড় ফাটল ধরিয়েছে। কয়েকটি শহরের পতন হয়েছে।

চীন-ভারত সীমান্তের পূর্ব বা পশ্চিমে চীনা সেনা সমাবেশের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে চীন রাতে ভারতের বিরুদ্ধে সম্প্রসারণশীল মনোভাবের অভিযোগ আনে। ভারতকে সমর্থন জানানোয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করে পাকিস্তানের সংগ্রামের প্রতি তারা পূর্ণ সমর্থন জানায়।

যুদ্ধ ঘোষণার পর

ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন ছিলেন মুক্তাঞ্চলে।

আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের প্রথম দিনই মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চারদিক থেকে যৌথ বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকা দখল এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের যুদ্ধেই বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অর্ধেকের বেশি বিমান এদিন বিধ্বস্ত হয়।

২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লার দেবীদ্বার মুক্ত হয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংকবহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। সে খবর পেয়ে পাকিস্তানিরা রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়।

৬ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এদিন মুক্ত হয়। ফুলবাড়ী মুক্ত করতে ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী ফুলবাড়ীর বেতদিঘি, কাজিয়াল, এলুয়াড়ী, জলপাইতলী, পানিকাটা, রুদ্রাণী, আমড়া ও রানীনগর এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী যৌথ বাহিনীর ফুলবাড়ী শহরে আগমন রোধ করতে শহরের পশ্চিম পাশে ছোট যমুনা নদীর ওপর লোহার সেতুর পূর্ব অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়।

৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে চার ঘণ্টা লড়াই করে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দর্শনার ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে তারা পিছু হটে গেলে ৪ ডিসেম্বর দর্শনা শহর মুক্ত হয়।

১১ নম্বর সেক্টরে জামালপুরের বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটির প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনারা এদিন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।


 সূত্র:আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৫-৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর: ছয়, আট ও এগারো