গুমের ঘটনায় জড়িতদের কেউ যাতে আর রাজনীতিতে ফিরতে না পারেন, এমন দাবি উঠেছে। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকা প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি গুমের শিকার পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
‘গুমের জবানবন্দি ও স্মৃতির প্রতিরোধ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, গুমের শিকার ব্যক্তি এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে এই তিন দাবি জোরালোভাবে তোলা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের একটি মিলনায়তনে ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ রিসার্চ এনালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন) নামের একটি সংগঠন।
সভায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় কেউ গুম করে পার পায়নি, বাংলাদেশেও পার পাবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারে যারা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা আর ফিরতে পারবে না। গণভবনে করা জাদুঘরে গুমের সবকিছু সংরক্ষিত থাকবে।
শেখ হাসিনা দেশে মাফিয়াতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, গুম করার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে কেউ যেন চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। যেসব লোক গুম করার কাজগুলো করছিল, একপর্যায়ে তারা দেখে, এটা তো করা যায়। তখন তারা ব্যক্তিগত স্বার্থেও অনেককে গুম করেছে। সে ধরনের ঘটনাও পাওয়া যাচ্ছে। গুম করার পর ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতিটি গুমের ঘটনার বিচার করা হবে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, সে জন্য সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারের অঙ্গীকার হচ্ছে প্রত্যেকটা গুমের ঘটনা তদন্ত করা এবং জড়িতদের বিচার করা। এটা কষ্টসাধ্য কাজ, তবে এতে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। সব আয়নাঘর ধ্বংস করা হবে বলেও জানান তিনি।
গুম করার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে কেউ যেন চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।
গুম হওয়া বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বলছে, আয়নাঘর বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আয়নাঘর দেখার অধিকার গুমের শিকার পরিবারগুলোর ছিল। ভুক্তভোগীর পরিবার দেখতে পারত সেখানে তাদের স্বজনেরা আছেন কি না। দেশে গুমবিরোধী আইন থাকা দরকার। সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ছাড়াও একটি বড় চক্র গুমের ঘটনায় জড়িত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এই সংগঠনের সংগঠক সানজিদা ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যারা গুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিদেশে চলে গেলেও দেশে এনে তাদের বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, গুমের শিকার পরিবারগুলো এখনো স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আশায় আছে।
সানজিদা ইসলাম তাঁর বক্তব্যের মাঝে অনুষ্ঠানের মঞ্চে ডেকে নেন দর্শক সারিতে বসা কয়েকজন শিশুকে। তাদের কারও বাবা ১০ বছর আগে, কারও বাবা ১২ বছর আগে গুম হন। এই শিশুদের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল নিজ নিজ বাবার ছবি। তারা পুরো অনুষ্ঠানে বাবার ছবি হাতে নিয়ে দর্শক সারিতে বসে ছিল।
গুমের প্রতিটি ঘটনার বিচার দাবি
শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলে গুম করার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা অর্জন করেছিলেন বলে মনে করেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান। তিনি মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অন্যতম একটি কারণ গুম করা। দেশে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে কেউ গ্রেপ্তার হলে খুশি হতো! কারণ, তাঁকে গুম করা হয়নি।
জুলাই–আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মতো গুমের শিকার ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে বলে মনে করেন নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোবাশ্বার হাসান। তিনি নিজেও গুমের শিকার হয়েছিলেন। গুমের শিকার পরিবারগুলোকে ভাতা দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সমাজে পেশাদার খুনি তৈরি করে গেছেন শেখ হাসিনা। সেই বাংলাদেশ যেন না ফিরে আসে, সে জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। গুমের প্রতিটি ঘটনার বিচার করার দাবি জানান তিনি।
গুম থাকা অবস্থায় যে কালো কাপড় দিয়ে চোখ ও হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল, তা অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা। তিনি বলেন, বেঁচে ফিরবেন এই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মারা গেছেন ভেবে তাঁর শেষকৃত্যও করে ফেলেছিল তাঁর পরিবার।
গুমের পরিকল্পনার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুই দফায় গুমের শিকার হয়েছিলেন হাসিনুর। তিনি আওয়ামী লীগের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান।
এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাইয়েদ আবদুল্লাহ। অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী শামারুহ মির্জার ভার্চ্যুয়াল বক্তব্য প্রচার করা হয়। তিনি বলেন, এমন একটি দেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে আর কখনো গুমের ঘটনা ঘটবে না।