৫৮৬ সরকারি হাসপাতাল
দিনে ৩৭ মৃত শিশুর জন্ম
মায়ের বয়স ১৬ বছরের কম ও ৩৫ বছরের বেশি, ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন পুষ্টির ঘাটতি ইত্যাদি কারণে মৃত শিশুর জন্ম হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে বিমর্ষ মুখে বসে ছিলেন রুনা আক্তার। চার ঘণ্টা আগে তাঁর ছোট বোন আসমা আক্তার (২২) মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। এটি ছিল তাঁর প্রথম সন্তান।
রুনা প্রথম আলোকে বললেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আসমার মৃত সন্তানের জন্ম হয়। ছয় দিন আগে তাঁর বোন প্রসববেদনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ জন্য বোনের স্বামীকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে একটা দিনও ওর জামাই ডাক্তারের কাছে নেয়নি।’
গত ৩১ মে বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের সামনে রুনার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।
হাসপাতালের নিবন্ধন অনুযায়ী, আসমার মৃত সন্তানের বয়স ছিল ৩২ সপ্তাহ বা আট মাস। মায়ের গর্ভে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে।
দেশে বিদ্যমান মাতৃসেবা কর্মসূচি সঠিকভাবে কাজ করলে বছরে ৮৩ হাজার শিশুর অধিকাংশই পৃথিবীর বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারত। দেশে স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য হওয়ায় মৃত শিশু জন্মের হিসাব পাওয়া খুবই কঠিন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এ হিসাব না রাখলে, মৃতজন্ম প্রতিরোধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।ইশতিয়াক মান্নান, সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্যবিদ
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে সরকারি ৫৮৬টি হাসপাতালে আসমার সন্তানের মতো দিনে গড়ে ৩৭টি মৃতশিশু জন্ম নিচ্ছে। দেশে নবজাতক মৃত্যুর দুই–আড়াই গুণের বেশি জন্ম হচ্ছে মৃত শিশু। সাধারণত মায়ের গর্ভে ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ করার পর কোনো শিশু মারা গেলে সেটিকে মৃতজন্ম বা মৃত প্রসব বলা হয়। এ সময়ের আগে গর্ভে শিশুর মৃত্যুকে গর্ভপাত বলা হয়। তবে কোনো কোনো সংজ্ঞায় ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভে থাকার পর মৃত শিশুর জন্ম হলে মৃতজন্ম বলা হয়।
মৃত শিশুর জন্মের কারণ
মৃত শিশু জন্মের কারণ সম্পর্কে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের বয়স ১৬ বছরের কম ও ৩৫ বছরের বেশি হলে, মায়ের স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও সংক্রমণ থাকলে, ৪২ সপ্তাহের বেশি বিলম্বিত গর্ভধারণ হলে, প্রসবপূর্ব সেবা, গর্ভকালীন পুষ্টি ও যত্নের ঘাটতি হলে এবং প্রসবের সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মৃত শিশু জন্মের ঝুঁকি থাকে।
অধ্যাপক ফেরদৌসী বলেন, দেশে মৃতজন্মের হার বেশ বেশি। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় এখনকার তুলনায় ৬ থেকে ৮ গুণ বেশি পদক্ষেপ নিলে মৃতজন্ম, নবজাতক মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু প্রত্যাশিত হারে কমবে। সন্তান প্রসবের সময়ে হাসপাতালে না আনা এবং হাসপাতালে আনার পর নিরাপদ প্রসবের যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রসব প্রক্রিয়ার একদম শেষ পর্যায়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মৃতজন্মের ঘটনা ঘটে।
‘মৃতজন্মের হার আমাদের দেশে কিছুটা বেশি। তবে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। মৃতজন্মের কারণগুলো বের করা হয়েছে। মৃতজন্ম, মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। ফলে প্রসবপূর্ব ও গর্ভকালীন সেবা ও নিরাপদ প্রসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন জোরদারের মাধ্যমে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। সরকার ‘দ্য এভরি নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে।মো. শামসুল হক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন পরিচালক (মা, নবজাত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য)
হাজারে ৩৩ মৃতজন্ম
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত দেশের ৪৩০ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা পর্যায়ে ১০ থেকে ২৫০ শয্যার ১২৩টি হাসপাতালসহ মোট ৫৮৬টি সরকারি হাসপাতালে চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ৭ হাজার ৭৯৫টি মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। সাত মাসে নবজাতক মৃত্যুর দ্বিগুণেরও বেশি এই সংখ্যা। ওই সময়ে জন্ম নেওয়া মোট শিশুর সঙ্গে তুলনা করলে প্রতি হাজারে ৩৩টি মৃত শিশু জন্ম নিচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট মৃতজন্মের মধ্যে ৩ হাজার ৭৩৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, ২ হাজার ৪১৩টি জেলা হাসপাতালে এবং ১ হাজার ৬৪৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ১৫ হাজার ৭৫৩টি, ২০২০ সালে ১৪ হাজার ২৫৫টি এবং ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৯৫৯টি মৃতজন্ম হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সরকারি ৫৮৬টি হাসপাতালের চিত্র। এর বাইরে বাড়িতে ও বেসরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি সন্তান প্রসব হয়। সেসব স্থানে কত মৃতজন্মের ঘটনা ঘটছে, তার কোনো হিসাব নেই।
সরকারি তিনটি বড় জরিপ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্যজরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭–১৮, মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ এবং বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০–এর প্রতিবেদনে মৃতজন্মের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। বিডিএইচএসের সর্বশেষ ২০১৭–১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, মাত্র ৫০ শতাংশ সন্তানের জন্ম হয় হাসপাতালে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে হয় ১৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন পরিচালক (মা, নবজাত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য) মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৃতজন্মের হার আমাদের দেশে কিছুটা বেশি। তবে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। মৃতজন্মের কারণগুলো বের করা হয়েছে। মৃতজন্ম, মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। ফলে প্রসবপূর্ব ও গর্ভকালীন সেবা ও নিরাপদ প্রসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন জোরদারের মাধ্যমে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। সরকার ‘দ্য এভরি নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে।
মৃতজন্মে বাংলাদেশ সপ্তম
২০২০ সালে ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘অ্যা নেগলেকটেড ট্র্যাজেডি: দ্য গ্লোবাল বার্ডেন অব স্টিলবার্থ’ (উপেক্ষিত দুঃখজনক ঘটনা: মৃতজন্মের বৈশ্বিক বোঝা) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মৃতজন্মের ঘটনা ঘটছে। তিনটি সংস্থা ‘দ্য এভরি নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি দেশে মৃতজন্ম প্রতি হাজারে ১২–এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বে এখন মৃতজন্মের হার প্রতি হাজারে প্রায় ১৪।
২০১৬ সালে মেডিকেল সাময়িকী ল্যানসেট–এ ‘এন্ডিং প্রিভেনটেবল স্টিলবার্থ’ (প্রতিরোধযোগ্য মৃতজন্মের অবসান হোক) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে ৮৩ হাজার মৃত শিশু জন্ম নেয়। সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। প্রথম ও তৃতীয় অবস্থানে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তান। বাকি সাতটি দেশের ইন্দোনেশিয়াসহ আফ্রিকার ছয়টি দেশ রয়েছে। তবে প্রতি হাজারে মৃতজন্মের তালিকায় শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে পাকিস্তান শীর্ষে (প্রতি হাজারে ৪৩)। বাকি নয়টি দেশ আফ্রিকার।
বিএমসি প্রেগন্যান্সি অ্যান্ড চাইল্ডবার্থ সাময়িকীতে দেশের গ্রামাঞ্চলে মৃত শিশু জন্মের ওপর প্রকাশিত ‘স্টিলবার্থ সার্ভিল্যান্স অ্যান্ড রিভিউ ইন রুলাল ডিস্ট্রিক্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামে প্রায় ৫৪ শতাংশ মৃতজন্ম হয় বাড়িতে। মৃতজন্মের ১৫ শতাংশ মাতৃত্বকালীন উচ্চ রক্তচাপ, ১৪ শতাংশ রক্তক্ষরণ, ১১ শতাংশ অক্সিজেন স্বল্পতা এবং ৯ শতাংশ মাতৃত্বকালীন সংক্রমণ থাকার কারণে হয়েছে। বাকি মৃতজন্মের কারণ সুর্নিদিষ্টভাবে বোঝা যায়নি। ৪৮ শতাংশ মা উচ্চ প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছ থেকে গর্ভকালীন সেবা নিয়েও মৃত শিশু জন্ম দিয়েছেন।
সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্যবিদ ইশতিয়াক মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বিদ্যমান মাতৃসেবা কর্মসূচি সঠিকভাবে কাজ করলে বছরে ৮৩ হাজার শিশুর অধিকাংশই পৃথিবীর বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারত। দেশে স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য হওয়ায় মৃত শিশু জন্মের হিসাব পাওয়া খুবই কঠিন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এ হিসাব না রাখলে, মৃতজন্ম প্রতিরোধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।