সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য শহরে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া হয়। নিউইয়র্ক শহরে সড়ক থেকে শুরু করে আবাসন ও সব ধরনের সেবা সিটি করপোরেশনের আওতায়। আমাদের রাজধানী ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশন থাকলেও শহরের বেশির ভাগ সেবা ও গুরুত্বপূর্ণ খাত সিটি করপোরেশনের আওতায় নেই। যে কারণে নগরায়ণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলো তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর মধ্যে নগর ব্যবস্থাপনায় একক কর্তৃপক্ষের আওতায় সবকিছু চলতে হবে।’
রেহমান সোবহান বলেন, অতি নগরায়ণের ফলে ঢাকায় যানজট বাড়ছে। নগরায়ণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সমন্বয়হীনতার কারণে দ্রুত নগরায়ণ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আবাসন কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে দেশের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফলে এখানকার সেবা খাতের মধ্যে সমন্বয় আনা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) আয়োজিত এক বিশেষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। গতকাল শনিবার রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে স্থায়িত্বশীল নগরায়ণ: সমস্যা ও সমাধান’বিষয়ক ওই বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বেন-এর প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম। এতে তিনি বলেন, ঢাকা শহর বছরে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। বিশ্বের বড় শহরগুলোর মধ্যে এই বৃদ্ধি সর্বোচ্চ। এখানে বড় বড় ভবন, বিশাল বিশাল রাস্তা, মেট্রোরেল ও পাতালসড়কের মতো মেগা প্রকল্প হচ্ছে। তৈরি পোশাক কারখানার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই শহর। গত দুই যুগে এখানকার জনসংখ্যা ৫ গুণের বেশি বেড়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের ওপরে এখানে বসবাস করে।
ঢাকার ওই ‘উন্নতি’কে অতিবৃদ্ধি হিসেবে চিহ্নিত করেন নজরুল ইসলাম। তিনি এ ধরনের বৃদ্ধি বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মত দেন। কারণ, তা দেশের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য তৈরি করছে। একই সঙ্গে ঢাকায় বিনিয়োগ অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। শহরের সেবাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে বলে মন্তব্য করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি জেলা শহরে একটি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললে উন্নয়ন বৈষম্য কমবে।’
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে নগরায়ণের ভৌগোলিকভাবে অসম বৈশিষ্ট্যের একটি প্রকাশ হলো ঢাকা শহরের অতিবৃদ্ধি। যার জনসংখ্যা ১৯৮০ সালের ৩২ লাখ ৬০ হাজার থেকে ২০২৩ সালে ২ কোটি ৩২ লাখে পৌঁছেছে। শহরের বাসিন্দাদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ, তার ৫২ শতাংশই আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।
সঠিক নগরায়ণের উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে বলা হয়, সেখানে ৮০ শতাংশ মানুষকে গ্রামে রেখেই শ্রীলঙ্কা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর চীনের গ্রামাঞ্চলে টাউনশিপ-ভিলেজ-এন্টারপ্রাইজ নামে পরিচিত অসংখ্য শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। তাতে ১০ কোটির বেশি মানুষের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাপার সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ একসময় ছিল গ্রামনির্ভর দেশ। কিন্তু দেশে দ্রুত নগরায়ণের কারণে তা ধীরে ধীরে শহরকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ৬৫ শতাংশ আসে শহর থেকে। আর ঢাকা থেকে আসছে ৩৬ শতাংশ। এটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে। অথচ শুধু ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ অধিবাসী বস্তিতে থাকে। তাদের জন্য পানি ও অন্যান্য সেবা–সুবিধা কম। যে কারণে এই শহর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ বাড়াতে হবে। ছোট ও মাঝারি শহরের পাশাপাশি গ্রামগুলোতে জরুরি সেবা পৌঁছে দিতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বৈষম্যে ঝুঁকি বাড়বে
সম্মেলনের নগরায়ণ ও দুর্যোগ মোকাবিলাবিষয়ক কারিগরি অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জটিল ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে এখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে। আর এতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে ভবন ধসে পড়ার পাশাপাশি আগুন লাগার আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় বন্যা ব্যবস্থাপনায়। তারপর নদীভাঙন রোধে। ভূমিকম্প মোকাবিলায় বরাদ্দ মাত্র ৪ শতাংশ। বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য ভূমিকম্পের ঝুঁকির বিপদ বাড়িয়ে দেবে।
ওয়াটারএইড, বাংলাদেশ–এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসা পরামর্শগুলোকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে এগোনোর ওপর জোর দেন। তিনি দেশব্যাপী দূষণ ও পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে সবাইকে নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
বাপা সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকার নগরায়ণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য আছে। যেমন সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকায় বছরে পাঁচ লাখ মানুষ বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবে তা সাড়ে ছয় লাখের মতো। বেশি জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শহরের জলাভূমি ও কৃষিজমি দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণ আইন শক্তভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরায়ণকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সুরক্ষা করা সম্ভব।
বাপা সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাপার যুগ্ম সম্পাদক ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।