রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদন
প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের দ্বন্দ্বের দাবি ঘিরে অপতথ্যপ্রবাহের এক রাত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধানের দ্বন্দ্বের দাবি ঘিরে গতকাল মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে গুজব ছড়িয়েছেন বলে বেরিয়ে এসেছে রিউমার স্ক্যানারের একটি প্রতিবেদনে। তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠানটি প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের কথিত দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে অন্তত আটটি গুজব প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার সম্ভাব্য শুরু গতকাল দুপুরের পর। বেলা তিনটার কিছু পর ফেসবুকের কিছু পোস্টের ভাষ্য এমন ছিল, ‘হটাৎ ঢাকা যমুনা তে সেনাবাহিনী টাং সব নিয়ে বসে আছে ব্যাপার কি।’ (বানান অপরিবর্তিত) সন্ধ্যার পরও একই দাবি প্রচার করে পোস্ট হচ্ছিল ফেসবুকে।
৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনের সামনে সেনাবাহিনীর অবস্থান দেখা যায়। প্রধান উপদেষ্টা বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করছেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনাকে। এ বাসভবন ঘিরে পিজিআর, এসপিবিএন, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। থাকছে সেনাবাহিনীর এপিসিও (সাঁজোয়া যান)। তাই গতকাল শুরুতে যে দাবি প্রচার হচ্ছিল, তা নিতান্তই কৌতূহল সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল।
রিউমার স্ক্যানার বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায়, গতকাল রাত অন্তত নয়টার পর থেকে ফেসবুকে প্রচার হতে থাকে যে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসকে ঘিরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রুদ্ধশ্বাস বৈঠক চলছে। বিক্ষুব্ধ আর্মি অফিসাররা ইউনূসকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।’
ফেসবুকে দাবি করা হয়, ‘গত দুই মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি ইউনূস। ইউনূসের সময় ঘনিয়ে এসছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তাকে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে আজ। এর মধ্যে নির্বাচন দিয়ে পদত্যাগ করতে হবে ইউনূসকে।’ পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ দাবি ব্যাপকভাবে প্রচার হতে থাকে ফেসবুকে। সমজাতীয় দাবিতে কাজী মামুন ও মুফাসসিল ইসলাম নামের দুটি অ্যাকাউন্টের পোস্টের বরাতে বিষয়টি ভাইরালে রূপ নেয়। ফেসবুক থেকে বিষয়টি ছড়ায় ইউটিউব ও টিকটকেও।
গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার কিছু সময় পর যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানা পোলেন তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘ইউনূসকে (প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস) ওয়াকার উজ জামান (সেনাপ্রধান জেনারেল জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান) সাতদিন সময় বেঁধে দিয়েছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পক্ষান্তরে ইউনূস, ওয়াকার উজ জামানকে ২৪ ঘন্টার টাইম বেধে দিয়েছে পদত্যাগ করতে! সার্ভিস আলম সেনাপ্রধানের সঙ্গে বেয়াদবি করায় তাকে ধমকে বসিয়ে দিয়েছে আর্মির অফিসারদের কেউ একজন। বাকবিতন্ডা চলছে! এটাই যমুনার সর্বশেষ আপডেট।’ (বানান অপরিবর্তিত)
এখানে ‘সার্ভিস আলম’ বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমকে বোঝানো হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রিউমার স্ক্যানার এ বিষয়ে জানতে সারজিসের সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি বলছিলেন, গতকাল বিকেলের পর থেকে তিনি পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর ও সেনাবাহিনীর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছে রিউমার স্ক্যানার। তাঁরা বিষয়টিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত একটার কিছু পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাজমুল হাসান যমুনার সামনে থেকে একটি লাইভ ভিডিও প্রকাশ করেন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। তাঁর ভিডিওতে যমুনার সামনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান হয়।
নাজমুল আরেকটি ভিডিওতে জানান, আলোচিত দাবিটি সম্পূর্ণ গুজব। তাঁর ভিডিওতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়, যা অন্যান্য দিনেও থাকে।
ভাইরাল দাবিটির বিষয়ে অপতথ্যের প্রবাহ এখানেই থেমে যেতে পারত। তবে রিউমার স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে উল্টো চিত্র উঠে আসতে শুরু করে, ‘আমাদের সামনে (রিউমার স্ক্যানারের সামনে) একটি ভিডিও আসে, যার ক্যাপশনে দাবি করা হয়—যমুনায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে উপদেষ্টাদের বাগ্বিতণ্ডার ভিডিও এটি। তবে রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, এটি যমুনার সামনের কোনো ভিডিও নয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইতালির দূতাবাসের সামনে ভিসাপ্রত্যাশীদের জমায়েতের ভিডিও এটি।’
কাছাকাছি সময়ে যমুনার সামনের ভিডিও দাবি করে আরেকটি ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কিছু সেনাসদৃশ সদস্য যমুনায় প্রবেশ করছেন। জিওলোকেশন যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, ভিডিওটি যমুনার সামনে থেকেই ধারণ করা৷ তবে রিউমার স্ক্যানারের বিশ্লেষণে ভিডিওতে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাঁদের ধারণা, ডিউটির (কর্তব্য) সময় বদল হওয়ায় একদল সেনা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের যমুনায় প্রবেশের ফুটেজ হতে পারে এটি। এ ছাড়া সমন্বয়ক নাজমুলের লাইভ ভিডিও থেকেও স্পষ্ট যে যমুনার সামনে কোনো অস্বাভাবিক বা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবতারণা হয়নি।
কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্টে যমুনার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িবহরের অবস্থানের দৃশ্য দাবি করে একটি ছবি প্রচার করা হচ্ছে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, রাজবাড়ীতে গতকাল সকালে দুর্গামণ্ডপের পাঁচটি প্রতিমার মুখের অংশ আংশিক ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে অবস্থানের দৃশ্য এটি।
এদিকে কিছু ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়, সমন্বয়ক থেকে উপদেষ্টা পদে যাওয়া এক ব্যক্তিকে যমুনায় বৈঠকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন এক সেনা অফিসার। কথিত এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ভিডিও ফুটেজ প্রচার করা হয়, যাতে হাসনাতকে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হতে আহ্বান জানাতে দেখা যায়।
তবে ভিডিওটি সাম্প্রতিক নয়। গত ২৫ আগস্ট হাসনাত তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভ ভিডিওটি প্রকাশ করেন, যাতে তিনি জানান, ‘সবাই রাজুতে আসেন। স্বৈরাচারী শক্তি আনসার হয়ে ফিরে আসতে চাচ্ছে। দাবি মানার পরও আমাদের সবাইকে সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছে।’
সমন্বয়ক সারজিস আলমও রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দাবিতে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম ব্যবহার করে ভুয়া পোস্টের স্ক্রিনশট বানিয়েও প্রচার করা হয়েছে। আদতে সারজিস এমন কোনো পোস্টই করেননি।
রিউমার স্ক্যানার ভাইরাল এসব দাবি নিয়ে যাচাই করতে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ছবি খুঁজে পায়। ফেসবুকের একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে কথিত এই প্রেস রিলিজে। সাধারণ জনগণকে আহ্বান জানানো হয় রাস্তায় নেমে আসার। দাবি করা হয়, আরেকটি লড়াই করার সময় হয়েছে।
সেনাবাহিনীর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সাধারণত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মাধ্যমে প্রচার করা হয়। রিউমার স্ক্যানার এ বিষয়ে জানতে আইএসপিআরে যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকে রিউমার স্ক্যানারকে জানানো হয়, এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তাদের প্রকাশিত নয়।
আইএসপিআর বলছে, তারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে তাতে সেনা কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর থাকে এবং তা অফিশিয়াল প্যাডে প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। এর কোনোটিই কথিত এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে ঘটেনি।
অর্থাৎ গতকাল (৮ অক্টোবর) অন্তত দুপুর থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা, যেটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে সেনাবাহিনীর কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার ইঙ্গিতপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটে ফেসবুকে। শুরুতে যমুনায় সেনাবাহিনীর ট্যাংকের অবস্থানের বিষয় তুলে ধরে কৌতূহল সৃষ্টি করা হয়। যদিও গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে ট্যাংকের অবস্থান দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন (বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন) যমুনাসহ রাষ্ট্রীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে সেনাবাহিনী ট্যাংকের মাধ্যমে টহল দিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে রাতে ভাইরাল হতে থাকে সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে ড. ইউনূসের দ্বন্দ্বের দাবি। যদিও এমন কোনো প্রমাণ রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে মেলেনি।
পরে এ দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সেনাবাহিনীর নিয়মিত কার্যক্রমের ভুয়া ভিডিও, সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিও, সমন্বয়ক সারজিস আলমের নামে ভুয়া পোস্ট স্ক্রিনশট, ভিন্ন ঘটনার ছবি-ভিডিও, সেনাবাহিনীর নামে ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিসহ একাধিক উপায় অবলম্বন করে ক্রমাগত প্রচার করা হয়েছে বিষয়টি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধানের কথিত এ দ্বন্দ্বের বিষয়কে ঘিরে গত রাতে মূল দাবিসহ অন্তত আটটি গুজব প্রচারের প্রমাণ পায় রিউমার স্ক্যানার।