সেই স্থান, সেই সময়, ৫২ বছর আগের এক শীতের দিনের শেষ বেলা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি হেঁট মস্তকে হেঁটে আসছেন রমনার উদ্যানের সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে। নিয়াজির পাশে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছেন মিত্রবাহীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকারসহ মিত্রবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
আর মাত্র কয়েক মিনিট পরে এক ইতিহাস রচিত হবে এই উদ্যান চত্বরে। ঘড়িতে তখন ৪টা ৩১ মিনিট। জেনারেল অরোরা বীরত্বব্যঞ্জক বিজয়ানন্দে একটি দলিলে স্বাক্ষর করে এগিয়ে দিলেন নিয়াজির দিকে। ৯৩ হাজার নরঘাতক, ধর্ষণকারী, লুটেরা হানাদার সেনার পরাজিত সেনাপতি নিয়াজি গ্লানিমাখা মুখে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করলেন। কোমর থেকে অস্ত্রটি বের করে সমর্পণ করলেন বিজয়ী সেনানায়কের কাছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুখর হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে।
আজ শনিবার মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মসমর্পণের মুহূর্তটি নতুন প্রজন্মের দর্শদের কাছে ফুটিয়ে তোলার এই আয়োজন করেছিল সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। ফোরাম আজ বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনের প্রাঙ্গণে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও ৫৩তম বিজয় দিবস উদ্যাপন’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বেলা সাড়ে তিনটায়। ঠিক চারটা ৩১ মিনিটে নিয়াজির আত্মসমর্পণের দৃশ্যটির মঞ্চায়ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রাক্তনীদের নাটকের দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যসংসদের শিল্পীরা। বিজয় উৎসব উদ্যাপন করতে আসা বিপুল দর্শক জাতির গৌরবময় মুহূর্তের এই দৃশ্যের পুনরাভিনয়ের দৃশ্যটি দেখে আনন্দিত, উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। দৃশ্যটির মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অভিনেতারা যখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন নতুন প্রজন্মের দর্শকেরাও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্লোগানে যেন ৫২ বছর আগের দিনটিই ফিরিয়ে আনলেন।
অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালের প্রেরণাময় সংগীত, নৃত্য, নতুন প্রজন্মের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় পতাকা হস্তান্তর ও আলোচনা অনুষ্ঠান দিয়ে। স্বাগত বক্তব্য দেন ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হারুন হাবীব। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের সংরক্ষণ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় একটি মানবিক সমাজ গঠন করতে চাই। এ জন্য নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে ফোরাম কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন চত্বরে বিজয় উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। মাঝে করোনা অতিমারির জন্য আয়োজনে ছেদ পড়েছিল।’
এরপর ফোরামের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শিল্পী জান্নাত ই ফেরদৌসীর নেতৃত্ব ছিল সম্মেলক কণ্ঠের গান ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’। গানের পরে বক্তব্য দেন ফোরামের নির্বাহী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম। তিনি একাত্তরে বাঙালিদের ওপরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাকে জাতিসংঘের ‘গণহত্যা’ স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি পয়লা ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ দিবস ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
এরপর ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানের সঙ্গে সালমা মুন্নীর নেতৃত্বে নৃত্য পরিবেশন করেন নাচের দল ‘নৃত্যাক্ষ’-এর শিল্পীরা। এরপর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ফোরামের জ্যেষ্ঠসহ সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার। সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ গানটি। গানের পর ঘোষণাপত্র পাঠ করেন যুগ্ম মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মাবুদ। এরপর ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের হিরণ্ময় উক্তি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও ‘দে তালি বাঙালি’ গান মিলিয়ে একটি সমবেত নৃত্য।
নাচের পর্ব শেষ হতেই মঞ্চ থেকে ঘোষণা আসে ‘সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত সমাগত। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করতে আসছেন পরাজিত এ এ কে নিয়াজি।’ মঞ্চে টেবিল-চেয়ার পাতা হলো। মুহুর্মুহু হুইসেলের শব্দ শোনা গেল দর্শকের পেছনে অর্থাৎ মঞ্চের উত্তর প্রান্তে। ছবিতে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমন পোশাকে সজ্জিত হয়ে জেনারেল অরোরা, নিয়াজি, এ কে খন্দকারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকায় অভিনেতারা এগিয়ে এলেন মঞ্চে। তারপর সেই আত্মসমর্পণের দলিলে দুই পক্ষের স্বাক্ষর ও নিয়াজির অস্ত্রসমর্পণ। সব মিলিয়ে মিনিট পাঁচেকের আয়োজন। তবে তার রেশ থেকে গেল হৃদয়ে হৃদয়ে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে হারুন হাবীবের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় পতাকা তুলে দেন নবীন প্রজন্মের হাতে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ফোরামের সহসভাপতি ম. হামিদ। পতাকা হস্তান্তরের সময় শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটি। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই বিজয় উৎসবের আয়োজন।