‘সরু খালে গোলাপি ডলফিনের এমন ডিগবাজি আগে দেখিনি’
নাম গোলাপি ডলফিন হলেও অনেকে অবশ্য একে ‘সাগরের রাজকন্যা’ বলেন। ব্যতিক্রমী গায়ের রং ছাড়া এই ডলফিনের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর আকৃতি ও ওজন। পৃথিবীতে যে আট প্রজাতির ডলফিন আছে, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় ও বিরল। সাধারণত বেশি লবণাক্ত পানিতে এরা বিচরণ করে। বঙ্গোপসাগরে কিংবা মোহনায় কালেভদ্রে দেখা যায়। নদীতে দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। গত সপ্তাহে গোলাপি ডলফিনের সঙ্গে এক সোনালি বিকেল কাটানোর গল্পই আজ শোনাব।
২০০২ সালে প্রথমবার ‘ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি’র একটি জরিপে বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্বের কথা জানানো হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে বঙ্গোপসাগরে দেখা যায়। এরপর ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো সুন্দরবনের নদীতে ডলফিন শুমারির সময় এদের দেখা মেলে।
পৃথিবীতে গাঙ্গেয় শুশুক বা ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, পাখনাহীন পয়পয়েস ডলফিন, থেবড়া দাঁত ডলফিন, বোতলনাক ডলফিন, চিত্রা ডলফিন, ঘূর্ণি ডলফিন ও গোলাপি ডলফিন নামে আটটি প্রজাতি আছে। ২০০৪ সালে উপকূলীয় এলাকায় জরিপ করে ছয় হাজার ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইরাবতী ডলফিন আছে বাংলাদেশের সুন্দরবনে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীর চার স্থানকে ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে।
ভোর থেকে অপেক্ষা
ভোর থেকে ঘন কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারপাশ। কুয়াশা বেশি হলেও শীত অবশ্য খুব একটা লাগছে না। সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় শীতের তীব্রতা সব সময়ই এমন মনে হয় আমার কাছে। উত্তরের বাতাস নেই, তবে সাগর থেকে আসা মৃদু হাওয়া বইছে। সে বাতাসের তোড়ে কুয়াশা এসে গায়ে লাগছে। মান্দারবাড়িয়া সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ। এখানে আমরা আছি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে।
মান্দারবাড়িয়া ফেলে আমাদের নৌকা (জালিবোট) রায়মঙ্গলে গিয়ে পড়েছে। রায়মঙ্গলের ওপারে থাকা বনের নাম হলদিবুনিয়া। রায়মঙ্গল ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনের সীমানা। হলদিবুনিয়া ছোট দ্বীপের মতো বনাঞ্চল। হলদিবুনিয়ার পশ্চিমে গাঁ ঘেঁষে ভারতের সুন্দরবন। সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে রায়মঙ্গলের পাড় ভেঙে বিলীন হচ্ছে সুন্দরবনের গাছপালা। গত দশক ধরেই এটা লক্ষ করছি। ফলে লম্বা-চওড়া চর জেগেছে বিস্তৃত পাড়জুড়ে। রায়মঙ্গল ধরে আমরা উত্তর দিকে এগোচ্ছি।
ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে তিনটা। মান্দারবাড়িয়ার উত্তরে মাইটা খালের পশ্চিম প্রান্তের¯কাছাকাছি জায়গা দিয়ে উত্তর দিকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বনের পেটে ঢুকে গেছে বাইসিংহ ভারানি। খাবার সেরে এ খালের দিকে রওনা দিয়েছি। খালের দুই পাড়ে দুটি জায়গায় আমাদের ক্যামেরা বসানো। ভারানির মুখ থেকে আমাদের নৌকা প্রায় ২০০ মিটার ভাটিতে। সূর্যের আলো পানিতে চিক চিক করছে। কপালে আলো পড়ায় ভালোও লাগছে। সকালের কুয়াশা আর বাতাস নেই।
কাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্ত
হঠাৎ আমাদের নৌকা থেকে প্রায় দেড় শ মিটার সামনে আলতো করে ভেসে উঠল এক জোড়া ডলফিন। একটি হালকা গোলাপি, অন্যটি ছাইরঙা। নৌকা সূর্যের বিপরীত দিকে থাকায় ভালো ছবি এল না। মাঝি ইমরানকে দ্রুত নৌকা খালের মুখে নিয়ে পাড়ের গাছে বাঁধতে বললাম। এতে সূর্যের আলোর সুবিধাটাও পাওয়া যাবে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আরও তিনটি ডলফিন এসে যোগ দিল আগের দুটির সঙ্গে। মাছের পেছনে ছুটতে গিয়ে যেন জলকেলিতে মেতে উঠল ডলফিনগুলো।
মাত্র ভাটা শুরু হয়েছে। ভাটার সময় সরু খালের মাছ নেমে আসে বড় নদীতে। খালের এমন সংযোগস্থলের পাক খাওয়া পানিতে ডলফিন জড়ো হয় মাছ শিকার করতে। বাইসিংহ ও মাইটা খালের এই খাঁড়িও তেমন একটি সংযোগস্থল। মাছ তাড়া করে ডলফিনগুলো দক্ষিণ দিকে ছোটাছুটি করছে। হঠাৎ এক জোড়া ডলফিন আমাদের নৌকা থেকে মাত্র কুড়ি হাত দূরে মাছ তাড়া করতে গিয়ে লাফ দিয়ে হাওয়ায় ভেসে উঠল। আমরা প্রায় ভড়কেই গেলাম। যে মাছটি তাড়া করছিল, সেটিও বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। বেশ বড় আকারের একটি ভাঙন মাছ, মাঝেমধ্যে সে-ও লাফ দিচ্ছে বাঁচার জন্য। এতে করেই মাছটি সহজে চিনতে পারলাম আমরা।
জোড়া ডলফিন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবারও লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে গেল। পড়ল গিয়ে আমাদের নৌকা ঘেঁষে। অল্পের জন্য নৌকার ওপর এসে পড়েনি। আমরাও অনেকটা সরে নৌকার এক পাশে চলে এসেছি। ক্যামেরার শাটার চেপে চলেছি একটানা। ক্যামেরার ফ্রেমে ছবি ধরতে পারছি কি না, বুঝতে পারছি না।
এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে গেল। ডলফিনগুলো আমাদের নৌকা থেকে একটু দূর দিয়ে মাছের পেছনে ছোটাছুটি করছে। তখনো ছবি তুলছি। একসময় মনে হলো, ক্যামেরার মেমোরি কার্ড হয়তো এতক্ষণে ভরে উঠেছে। ভাবলাম, এবার একটু দেখা যাক। এই ভেবে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখলাম। একের পর এক ছবি দেখছি। মনের মতো কিছু ছবিও তুলেছি। কিন্তু ডলফিনের শূন্যে লাফ দেওয়ার ছবি পাচ্ছি না।
মনে আফসোস জমতে শুরু করেছে। হঠাৎ পেয়ে গেলাম সেই চমকে যাওয়া মুহূর্তের ছবি। ভাঙন মাছের পেছনে ছুটে চলা দুটি ডলফিনের একটি পুরো ফ্রেমে এসেছে। ছবির ফোকাস মন্দ নয়। আনন্দে মনটা নেচে উঠল।
সুন্দরবনে গোলাপি ডলফিনের ছবি আগেও তুলেছি। উপকূলীয় এলাকায় গোলাপি ডলফিন সচরাচর দেখা গেলেও সুন্দরবনে এরা বেড়াতে আসে কদাচিৎ। তবে বনের ভেতরের সরু খালে গোলাপি ডলফিনের এমন ডিগবাজি আগে কখনো দেখিনি। সুন্দরবনের এমন নির্মল পরিবেশে বিকেলের সোনা রোদ গোলাপিদের মন রাঙিয়ে তুলেছিল কি না, কে জানে। এমন বিরল প্রাণীরা যেন আমাদের অনাবিল আনন্দ দিতেই বুঝি আচমকা হাজির হয়েছিল শ্যামলিয়া বনের সেই স্বচ্ছ পানিতে।
এম এ আজিজ, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়