গবেষণার তথ্য
খুলনা অঞ্চলে স্ট্রোক বেশি
লবণাক্ততা বেশি এমন এলাকায় স্ট্রোক বেশি দেখা যাচ্ছে। কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ে আরও গবেষণা দরকার।
সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন-সংলগ্ন উপজেলা কালীগঞ্জের সোনাটিকারী গ্রামের মো. গোলাম বারির বয়স ৪০ বছরের কিছু বেশি। বছর তিনেক আগে তিনি স্ট্রোক বা পক্ষাঘাতের শিকার হন। তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেই থেকে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। চলাফেরা স্বাভাবিক হয়নি। আগে কৃষিকাজ করতেন তিনি, এখন মুদিদোকান চালানোর চেষ্টা করছেন।
২২ ফেব্রুয়ারি মো. গোলাম বারির স্ত্রী এই প্রতিবেদককে বলেন, বড় মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার পর মনটা ভালো ছিল না। একদিন হঠাৎ স্ট্রোক করে। তবে কেন স্ট্রোক করল, তার উত্তর তাঁদের জানা নেই। তিনি আরও বলেন, এলাকায় স্ট্রোক নতুন না। দুই বাড়ি পরে আরও একজন স্ট্রোকের রোগী আছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বুলবুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিতভাবে স্ট্রোকের রোগী হাসপাতালে না এলেও মাঝেমধ্যে রোগী আসে। গুরুতর রোগী সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
দেশের এই অঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বাসিন্দাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ বা স্ট্রোক বাড়ছে বলে আলোচনা আছে। এই অঞ্চলে পানীয় জলের সংকট চলছে। এলাকার নদী-খাল-বিল-পুকুরের পানি সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে বেশি লবণাক্ত। খাবারে ও পানীয় জলে লবণ বেশি। খাবার ও জলের সঙ্গে নিয়মিতভাবে লবণ বেশি খাওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক বেশি। তবে এ নিয়ে গবেষণালব্ধ সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে নেই।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে স্ট্রোকের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা বিভাগে। এ-ও দেখা গেছে, খুলনা বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে স্ট্রোক বেশি তিনটি জেলায়: খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে। গবেষণায় ময়মনসিংহ বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে স্ট্রোকের প্রবণতা ও ঝুঁকিবিষয়ক গবেষণাটি করেছে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স রিসার্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) থেকে সংগ্রহ করা পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, স্ট্রোকে মৃত্যুহার আট বিভাগের মধ্যে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে ২০ হাজার ৬৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে স্ট্রোকে। তাতে দেখা যাচ্ছে, খুলনা বিভাগে মৃত্যুহার (প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায়) শূন্য দশমিক ১৭। এরপর আছে ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ১৬। স্ট্রোকে মৃত্যুহার সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম বিভাগে, শূন্য দশমিক শূন্য ৬।
গ্রামাঞ্চলে স্ট্রোকের প্রবণতা ও ঝুঁকিবিষয়ক গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য এবং বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক খন্দকার এ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণা থেকে এটা জানতে পেরেছি যে খুলনা এলাকার মানুষের মধ্যে স্ট্রোক তুলনামূলকভাবে বেশি। এখন এটা জানা দরকার যে কেন এই এলাকায় স্ট্রোক বেশি। মাটি-পানি-খাবারে লবণ বেশি থাকার সঙ্গে বেশি স্ট্রোক থাকার সম্পর্ক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সম্পর্ক পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য কর্মসূচি সাজাতে হবে।’
স্ট্রোক হয় প্রধানত দুটি কারণে: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অথবা মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে। দেশে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রোক।
কীভাবে গবেষণা, কী দেখা গেছে
গবেষক দল পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচির অর্থায়নে দেশের সাতটি বিভাগের ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২ লাখ ৪২ হাজার ৩৪টি পরিবারের ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৯ জনের আর্থসামাজিক তথ্যের সঙ্গে রোগের তথ্য সংগ্রহ করেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিচালিত এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে।
ওই সব ব্যক্তির তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে স্ট্রোকের রোগী ছিলেন ১ হাজার ৪৩৬ জন। রোগতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে প্রতি এক হাজার বয়স্ক মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের রোগী এক দশমিক শূন্য সাতজন। স্ট্রোকের ঝুঁকি নারীর তুলনায় পুরুষের বেশি। পুরুষের মধ্যে স্ট্রোকের হার ১ দশমিক ২৯ এবং নারীর মধ্যে স্ট্রোকের হার শূন্য দশমিক ৮৩।
বিভাগভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্ট্রোকের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা বিভাগে। এই বিভাগে এক হাজার মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের রোগী ১ দশমিক ৭৭ জন। স্ট্রোক সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগের মানুষের মধ্যে (শূন্য দশমিক ৬২ জন)।
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই গবেষণা ফলাফলটা গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণা থেকে কিছু স্পষ্ট তথ্য জানা গেছে। পাশাপাশি এই গবেষণা কিছু নতুন প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। প্রথমত কোন কোন কারণে খুলনা এলাকায় স্ট্রোক বেশি, খুলনা এলাকায় উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ কেমন—এসব নিয়ে নতুন গবেষণা হতে পারে। তার ভিত্তিতে সরকারকে বা স্বাস্থ্য বিভাগকে স্ট্রোকের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।