২০২৪ সালের শেষ দিন আজ ৩১ ডিসেম্বর। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, বছরটি ছিল অনেক ঘটনার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে এই বছরে।
২০২৪ সালে রাজনৈতিক ঘটনাবলিই বেশি। রাজনীতির বাইরে এ বছর দুর্ঘটনা ও অপরাধের বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। বড় বন্যা হয়েছে। বাংলাদেশি জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। আদালতে বড় কিছু রায় হয়েছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে কিছু অর্জনও আছে।
বছরের শেষ মাসে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, তাদের চোখে ২০২৪ সালের সেরা দেশ বাংলাদেশ।
২০২৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে বড় ঘটনাগুলোর মধ্য থেকে ২৪টি পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো—
বছরটা শুরু হয়েছিল শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে। শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ডাদেশ দেন শ্রম আদালত। পরে এ মামলা টেকেনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এদিন। বিএনপিসহ ছোট-বড় অনেক দলের বর্জনের মুখে নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগ নিজ দলের ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করায়। পাতানো এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও দলের স্বতন্ত্ররা জিতে যান ২৮০টি আসনে।
বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে আগুন লেগে অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। অনেকেই ভবনটিতে গিয়েছিলেন রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে। আগুনের ঘটনার পর অগ্নিনিরাপত্তায় দুর্বলতা বেরিয়ে আসে। রাজধানীজুড়ে শুরু হয় ‘লোকদেখানো’ অভিযান। যদিও তাতে পরিবর্তন খুব একটা আসেনি।
ভারতকে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৭ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ শিরোপা জিতলেও এবারই প্রথম আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের ট্রফি নিজেদের করে নেয় বাংলাদেশ। কাঠমান্ডুর অদূরে ললিতপুরের আনফা একাডেমি মাঠ জায়গা পেয়ে যায় বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে।
সোমালিয়ার জলদস্যুরা ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে। জাহাজটিতে ছিলেন বাংলাদেশি ২৩ জন নাবিক। মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়া পায় ১৪ এপ্রিল রাতে। নাবিকদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম কলকাতায় চিকিৎসার জন্য গিয়ে আট দিন নিখোঁজ ছিলেন। ২২ মে তাঁর খুন হওয়ার বিষয়টি জানা যায়। তাঁর মরদেহ টুকরা টুকরা করে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে খুনিরা। ডিএনএ পরীক্ষার পর ২০ ডিসেম্বর নিশ্চিত হওয়া যায়, খণ্ডাংশগুলো তাঁর মরদেহের।
৫ জুন শুরু হওয়া সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৫ জুলাই হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পরদিন দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ওই দিন নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়জনে। এরপর থেকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, সন্ত্রাস-সহিংসতার সঙ্গে জামায়াত ও শিবিরের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যা, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি—নানা চেষ্টা করেও টিকতে পারেনি স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে। গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল প্রাথমিক হিসাবে জানিয়েছে, জুলাই ও আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে ৮৫৮ জন নিহত হয়েছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয় বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানেরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। উপদেষ্টা মোট ১৭ জন। পরে তা বেড়ে হয় ২২ জন। যদিও ২০ ডিসেম্বর এ এফ হাসান আরিফের মৃত্যুতে উপদেষ্টার সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ জনে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভের মধ্যে পদত্যাগ করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। পরে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় সৈয়দ রেফাত আহমেদকে।
ভারত থেকে আসা ঢল ও ভারী বর্ষণে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বন্যা শুরু হয়। দীর্ঘস্থায়ী ওই বন্যায় অন্তত ৫৯ জন নিহত হন। ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল।
অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি হলো সংস্কার। এ লক্ষ্যে ৩ অক্টোবর পাঁচটি ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এখন পর্যন্ত মোট ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
সারা বছর মূল্যস্ফীতি ভুগিয়েছে মানুষকে। অক্টোবরে ঢাকায় ডিমের ডজন ১৯০ টাকায় উঠে যাওয়া বাজারে অস্থিরতার একটি উদাহরণ মাত্র।
নতুন সরকার জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের উদ্যোগ নেওয়ার পর ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এই আদালত।
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে একই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে পরদিন ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের দাবি ছিল তিনটি—বিদেশে উন্নত চিকিৎসা, আর্থিক সহায়তা এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সাক্ষাৎ। পরদিন সচিবালয়ে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় উপদেষ্টা ও একজন বিশেষ সহকারী। বৈঠক শেষে সরকারের পক্ষ থেকে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠান চট্টগ্রামের আদালত। এ সময় সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ পরে জানায়, হত্যায় জড়িত কয়েকজন চিন্ময় অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। এই মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় ২ ডিসেম্বর বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিরা খালাস পান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। ২ ডিসেম্বর ভারতের আগরতলায় দেশটির উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করে। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ তলব করে ভারতের হাইকমিশনারকে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। দলের সঙ্গে বৈঠকের আগে ও পরে একই সংলাপ হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে।
বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের সেরা দেশ নির্বাচিত করে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরুর বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে তারা।
মেঘনা নদীতে নোঙর করা সারবাহী একটি জাহাজ থেকে সাতজনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচজনকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। র্যাবের দাবি, এক কর্মীই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।