মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির চিরকালের গৌরবের অর্জন। মুখে মুখে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা চলবে আনন্দ-বেদনায়। চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে চলার সাহস ও প্রেরণা লাভ করবে ভবিষ্যতের বাঙালিরা। সেই সূত্রেই বছরের শুরুর মাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হলো আজ সোমবার।
জাপানপ্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল হকের ইংরেজিতে লেখা ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপায়ার’ নামের বইটির মোড়ক উন্মোচন হলো বারিধারার গার্ডেন গ্যালারি কসমসে। কসমস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বইটি প্রকাশ করেছে কসমস বুক। এতে মোট ১৪টি অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে রয়েছে সেই বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শিল্পী সৌরভ চৌধুরীর শিল্পকর্ম।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মঞ্জুরুল হকের প্রথম বই ‘আ স্টোরি অব মাই টাইম’ কসমস বুকস প্রকাশ করেছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপায়ার’ আগের বইটির দ্বিতীয় অংশ। আত্মজৈবনিক রীতির এই দুই বইয়ে লেখক মঞ্জুরুল হক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধ এবং তাঁর নিজের যুদ্ধে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
বিকেলে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সমাগত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, তাঁর সঙ্গে লেখক মঞ্জুরুল হকের দীর্ঘ ৬০ বছরের বন্ধুত্ব। এখনো তাঁদের বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা প্রথম বইটি পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। এখন পরের অংশটি প্রকাশ করায় এ বিষয়ে তাঁর লেখা পূর্ণতা পেল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, এনায়েত উল্লাহ খানের বন্ধুভাগ্য ভালো। মঞ্জুরুল হক, আফসান চৌধুরী, হাসান ফেরদৌস, ড. হায়দার আলী খানসহ অনেকের সঙ্গে তাঁর ভালো বন্ধুত্ব। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কারণেই বইটির প্রকাশনা, বিক্রি করে আয় করা উদ্দেশ্য নয়। বইটি সম্পর্কে তিনি বলেন, মঞ্জুরুল হক চোখের সামনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হতে দেখেছেন। একাত্তরের ২৫ ও ২৬ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে তিনি তাঁদের বাসা থেকে সাইকেল নিয়ে বের হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে দুই বন্ধুর মৃতদেহ দেখতে পান। জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। অবরুদ্ধ ঢাকা শহর। ভীতিকর পরিবেশ। ঢাকা থেকে তাঁরা গ্রামে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যান আগরতলায়। সেই যাত্রাও ছিল বিপদসঙ্কুল। ক্যাম্প–জীবন। যুদ্ধে বিজয়ের পথে ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। এসবের বিবরণ দিয়েছেন বইতে।
অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ঢাকা কলেজ থেকে মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। তাঁরা একসঙ্গে ষাট দশকে শিল্প–সাহিত্যের চর্চা করেছেন। আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আমাদের সমাজ থেকে কীভাবে ১৯৭১ উঠে এল, সেই পরিপ্রেক্ষিত এই বইতে তুলে ধরেছেন লেখক। ১৯৭১ সালে ছিল আমাদের সমাজের মুক্ত হওয়ার চেষ্টা। এই চেষ্টার বিষয়টি বইটিতে উঠে এসেছে।
প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, সমাজ, দেশ, মানুষ সময় দিয়ে শাসিত হয়। এই দুই বইতে লেখক আমাদের ইতিহাসের একটি গৌরবময় সময়কে তুলে ধরেছেন।
বরেণ্য শিল্পী ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী বই। লেখক মঞ্জুরুল হক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছেন। এই বইয়ের অনেক ঘটনা সেই সময়ের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।
মঞ্জুরুল হক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাংলায় অনেক বই লেখা হলেও বিদেশি পাঠকের জন্য ইংরেজিতে লেখা বইয়ের সংখ্যা সে তুলনায় খুব কম। এ কারণেই তিনি ইংরেজিতে এই বই লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন। এই বই দুটিকে তিনি প্রথাগত ইতিহাসের বই বলতে সম্মত নন। এটি মূলত ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। প্রথম বইয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, ষাট দশকের আন্দোলন, এসব তুলে ধরেছেন। এই পর্ব শেষ হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চে। দ্বিতীয় পর্বের এই নতুন বইয়ে আছে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, রাজনীতির ভীতিকর পরিবেশ, মানুষের প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানো, তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ এবং বিজয়ের পর দেশে প্রবেশ—এই বিষয়গুলো। বইটি তিনি তাঁর পরের প্রজন্মের উদ্দেশ্যেই রচনা করেছেন। বিশেষ করে দুই নাতনির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা ও তাদের পরের প্রজন্ম যেন জাতির এই গৌরবময় অর্জন সম্পর্কে জানতে পারে, সে জন্যই তাঁর এই গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।
মঞ্জুরুল হক একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। সাংবাদিকতা করেছেন বিবিসিতে। ১৯৯৪ সাল থাকে তিনি জাপানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। জাপানের এনএইচকে রেডিওতে সাংবাদিকতা এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করছেন। প্রথম আলোর জাপান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে ইতিহাস, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে তাঁর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।
আলোচনার শেষে ছিল শতাব্দী সাহার পরিবেশনায় কবিতা আবৃত্তি।