গুম কমিশনের প্রতিবেদন লোমহর্ষক, অবিশ্বাস্য বর্ণনা: প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘গুম কমিশনের প্রতিবেদন লোমহর্ষক। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে, এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা!’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন। সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। তাঁর ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সম্প্রচার করা হয়।
ভাষণে ড. ইউনূস নির্বাচন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, শ্বেতপত্র কমিটি, ঐক্য কমিশন গঠন, সংস্কার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায় বলেছেন তিনি।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনের ভয়াবহতা তুলে ধরেন ড. ইউনূস। তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের আক্রোশের শিকার হয়ে ঘটনাচক্রে যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে সাহস করছেন না। তাঁদের ভয় কিছুতেই কাটছে না। তাঁদের ভয়, হঠাৎ যদি ওই জালেমরা আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাঁদের প্রতি এরা নৃশংসতম হবে। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে।’
সংস্কার কমিশনগুলো দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি, কমিশনগুলো এখন থেকে নিয়মিতভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা পেশ করতে থাকবে।’
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রধান করা হয় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিশন গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনায় কমিশনে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। দেশে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন।
শিগগিরই নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মিলে যে অসাধ্যসাধন করেছে তার অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকায় ছিলেন এ দেশের নারীরা। ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রাণঘাতী অস্ত্রের সামনে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছিল আমাদের মেয়েরা। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী—সকল পেশার, সকল বয়সের নারীরা এই আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, এ বছর বেগম রোকেয়া দিবসে দেশজুড়ে আন্দোলনে নারীদের আত্মত্যাগ ও ভূমিকার বিষয়ে বড় আকারে আলোচনা হয়েছে।ওই দিন জুলাই কন্যারাও ঘোষণা দিয়েছে তারা তাদের কথা কাউকে ভুলে যেতে দেবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী অধিকার রক্ষায় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করেছে। শিগগিরই তাঁরা তাদের রিপোর্ট দেবে। জুলাই কন্যারা ঘোষণা দিয়েছে প্রতি বছরের ১০ ডিসেম্বর তারিখে নির্ধারিত সময়ে সারা দেশে সকল পরিবারের নারী — - শিশু কিশোরী তরুণী বৃদ্ধা, একসঙ্গে নিজ নিজ নির্ধারিত স্থানে —সেটা উঠান হোক, বাড়ির সামনে রাস্তায় হোক — - সমাবেশ করে দেশের অর্ধেকাংশ মানুষের অস্তিত্বের কথা সারা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেবে। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে দেবে।
ড. ইউনূস আরও বলেন, যে তরুণীরা জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকল, তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থেকে আর কোনো দিন সরে যাবে না। তারা শুধু নতুন বাংলাদেশ নয় নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলার মহা কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের সকল বয়সের নারীদের সঙ্গে নিয়ে নেতৃত্ব দেবে।
বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা হটাতে পেরেছি। তারা এখনো সর্বশক্তি দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে, একের প্রতি অন্যের বিষ উগরে দিতে চাচ্ছে। তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই সফল হতে দেবেন না।’