সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ: নতুন খসড়ায় বিতর্কিত ধারা বাদ

সাইবার নিরাপত্তা আইনের বদলে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ করছে সরকার। খসড়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে বর্তমান আইনের বিতর্কিত ধারা।

প্রতীকী ছবি

বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর এ–সংক্রান্ত নতুন একটি আইনের খসড়া করেছে সরকার। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’। প্রাথমিক খসড়ায় বর্তমান আইনে থাকা বাক্‌স্বাধীনতা–সম্পর্কিত বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সম্প্রতি বলেছিলেন, সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নতুন যে আইন হবে, সেখানে কথা বলার জন্য কোনো অপরাধ হবে না। শুধু কম্পিউটারভিত্তিক অপরাধে শাস্তি থাকবে, যেটা সাইবার নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত।

নতুন আইনের খসড়াটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাক্‌স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মতো ধারা নেই। বর্তমান আইনে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিদ্বেষ-বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণায় শাস্তির বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সংজ্ঞা অস্পষ্ট। ফলে সাধারণ বক্তব্যের জন্য মামলা করা যেত এবং সে কারণে অনেক মানুষকে কারাগারে থাকতে হয়েছে।

ব্যাপক সমালোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ রহিত করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার সাইবার নিরাপত্তা ২০২৩ নামে একটি আইন পাস করে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও অধিকারকর্মীরা এটিকে নতুন মোড়কে পুরোনো নিবর্তনমূলক ধারাসংবলিত আইন বলে এসেছেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) চলতি বছরের এপ্রিলে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাঁচ বছরের চিত্র নিয়ে কঠিন পরীক্ষা’ নামে একটি গবেষণা প্রকাশ করে। সেখানে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। সিজিএস জানায়, অভিযুক্তের মধ্যে ৩২ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ, ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক। অভিযোগকারীর প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

যে পরিবর্তন এসেছে

বর্তমান সরকারের করা সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের প্রাথমিক খসড়াটি ঘেঁটে দেখা যায়, এতে বিতর্কিত সাতটি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। ধারাগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড; পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণ; আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ, ইত্যাদি; অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার, ইত্যাদির দণ্ড; অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার, ইত্যাদির দণ্ড; সম্প্রচার, ইত্যাদি; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি; পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার।

আগের আইনে সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলের বিধান নতুন অধ্যাদেশে রাখা হয়নি। এ ছাড়া বাদ পড়েছে ক্ষমতা অপর্ণ, সাক্ষ্যগত মূল্য ও অসুবিধা দূরীকরণ ধারাগুলোও।

অপরাধের আওতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্ল্যাকমেইলিং (প্রতারণা) বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশ–সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড। খসড়ায় যে কারও মামলা করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরাসরি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তাঁর নিয়োগকৃত ব্যক্তি অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বাদে অন্য কেউ এ আইনের অধীন মামলা করতে পারবেন না। আগের আইনে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা উৎসাহ নিয়ে মামলা করতেন, যা বেশির ভাগই ছিল প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের অবমাননার জন্য।

সিজিএসের সর্বশেষ গবেষণা বলছে, তাদের বিশ্লেষণ করা ১ হাজার ৪৩৬টি মামলার মধ্যে দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা করেছেন ৩৩৮টি এবং ৫৭৭টি মামলা দায়েরকারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

অজামিনযোগ্য ধারা

অধ্যাদেশে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য মামলার ধারা হিসেবে রয়েছে, ১৪, ১৬, ২০ ও ২২, যা মূলত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো, কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, ইত্যাদির ক্ষতিসাধন ও দণ্ড, সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনের অপরাধ ও দণ্ড ও হ্যাকিং–সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের জন্য।

সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত হওয়ার পরও তার কিছু ধারার মামলার বিচার নতুন অধ্যাদেশেও চলবে। সেগুলো মূলত কম্পিউটারভিত্তিক অপরাধ ও ডিজিটাল প্রতারণা–সংক্রান্ত। অন্য মামলা বাতিল হয়ে যাবে।

প্রাথমিক খসড়া সম্পর্কে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ, জাতিসংঘ বা ইউরোপের চর্চা অনুসরণ করে এই আইনের শিরোনাম ‘সাইবার বা কম্পিউটার অপরাধ বা কম্পিউটার অপব্যবহার আইন’ হওয়া উচিত ছিল। সাইবার সুরক্ষার বিষয়গুলো আরও বিশদ এবং কেবল একটি আইন দিয়ে তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এই সরকারের সামনে একটি অসাধারণ সুযোগ ছিল যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চর্চা এবং বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে তা নিয়ে একটি বিশদ গবেষণা করে তারপর আইনটির খসড়া করা। তিনি বলেন, জাতিসংঘ গত আগস্টে ‘সাইবার ক্রাইম কনভেনশনের’ খসড়া প্রকাশ করেছে। সেটাকে সামনে রেখে এবং দেশের বিভিন্ন আইনে এ বিষয়ে যে বিধানগুলো রয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে তারপরই সরকার এই অধ্যাদেশ প্রণয়নে এগোতে পারত।

অধ্যাদেশের খসড়ার ধারা ৮–এ বলা আছে, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক সেসব অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবেন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ সাপেক্ষে, যদি বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা অপসারণ বা ব্লক করার জন্য মহাপরিচালকের মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।