সীমান্তে উত্তেজনা, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ

‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’-শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনেছবি: তানভীর আহাম্মেদ

মিয়ানমারে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে আর যাতে কোনো রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে না আসে, সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আজ শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজক ইউনিটি ফর বাংলাদেশ নামের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সরকারসহ সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে দীর্ঘ লড়াই-সংঘাতের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি। এতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে—দুই পারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে। রাখাইনে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হতে পারে।

অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান বলেন, রাখাইন রাজ্যের ৮০-৮৫ শতাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। বিশেষ করে যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের প্রধান বসবাস, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এর চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

খলিলুর রহমান বলেন, আরাকান আর্মির চূড়ান্ত অবস্থা কী হয়, সেগুলো এখনো অস্পষ্ট। তবে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। তবে গভীরভাবে বিবেচনা না করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না বলেও জানান তিনি।

বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি মানবিক বিপর্যয়ের বিষয় নয়, এটা দেশের অভ্যন্তরীণ এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ও উল্লেখ করে খলিলুর রহমান বলেন, একটা তাৎক্ষণিক উদ্বেগ ছিল বর্তমান অবস্থায় আরও বেশি করে রোহিঙ্গা শরণার্থী চলে আসে কি না। এটা যাতে না হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান করতে চায় সরকার। এ বিষয়ে খলিলুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার বিষয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এ সম্মেলন কাতারের দোহায় করার চেষ্টা চলছে।

এর আগে অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্যে লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের এত দিনকার নীতি–কৌশল অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ত্রুটি রোহিঙ্গাদের আসা ঠেকাতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এখন প্রধান শক্তি উল্লেখ করে আলতাফ পারভেজ বলেন, এখন আর মিয়ানমার সরকার চাইলেও রোহিঙ্গাদের আরাকানে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে আরাকান আর্মিরও সম্মতি লাগবে, এটা নতুন বাস্তবতা। তবে আরাকান থেকে পুরোপুরি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকেও উৎখাত করা যায়নি। ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বামারদেরও সম্মতি লাগবে।

রোহিঙ্গাদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে মিয়ানমার ও আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারেনি বলেও মনে করেন আলতাফ পারভেজ। তিনি মনে করেন, আগের বিদেশনীতির প্রায় আমূল পুনর্ভাবনাও প্রয়োজন।

রোহিঙ্গারা যাতে অধিকার সচেতন থাকে, সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সি আর আবরার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করা প্রয়োজন। এত বছর ধরে যেভাবে আছে, তারা আরও বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে যেতে পারত। রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত করতে হবে। যাতে তারা নিজেদের অধিকারকে রক্ষা করতে পারে।

মিয়ানমার বা রাখাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যু একমাত্র বিষয় নয় বলে মনে করেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান। ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকে বড় দুই প্রতিবেশীর (ভারত ও মিয়ানমার) একটির সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক না থাকাকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন তিনি। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা–বাণিজ্য করা, মানবিক করিডর খোলার প্রস্তাব দেন মাহফুজুর রহমান। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের রাখাইন সম্প্রদায়কে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বার্মা অ্যাক্টসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক কৌশল কাজে লাগাতে সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন মাহফুজুর রহমান। তাঁর প্রস্তাব, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মিসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো সব পক্ষের সঙ্গে সুবিধা অনুযায়ী যোগাযোগ করা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন মধ্যপ্রাচ্যে না করে আসিয়ান দেশ হিসেবে মালয়েশিয়ায় করার প্রস্তাব দেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী। তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার সব সময় রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী ও বাংলাদেশি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে রোহিঙ্গারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে দাবি করে মিয়ানমার। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে রোহিঙ্গাবিষয়ক সম্মেলন করলে মিয়ানমার বলতে পারে, এ অঞ্চলকে ইসলামিকীকরণ করা হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সায়মা আহমেদ মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইন মেনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। এ জন্য মিয়ানমার সরকার, আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠন ইউনিটি ফর বাংলাদেশের মুখপাত্র মঞ্জুর মঈন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন তরুণ লেখক তুহিন খান।