গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ৩১টি কূপ সংস্কারে জোর
দিনে চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ ২৮০ কোটি। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে, আমদানিও বাড়ছে না। তৎপর সরকার।
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন নিয়মিত কমছে। ফলে ঘাটতি পূরণে চড়া দামে বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। উৎপাদন কমতে থাকলে আমদানি আরও বাড়তে থাকবে। এই পরিস্থিতি সামলাতে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে অগ্রাধিকার বিবেচনায় ৩১টি কূপ সংস্কারে জোর দিয়েছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, অনুসন্ধান, সংস্কার ও উন্নয়ন কূপ মিলিয়ে ১০০টি কূপের প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। নতুন গ্যাসের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদনের জন্য নতুন করে উন্নয়ন কূপ খনন করা হয়। আর উৎপাদন কমে আসা পুরোনো কূপ বা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপ থেকে উৎপাদন বাড়াতে কূপ সংস্কার করা হয়। এখন গ্যাসের উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় কূপ সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ইতিমধ্যে ১৬টি কূপ সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি কূপের কাজ শেষে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সব কটি শেষ হলে উৎপাদন আরও বাড়বে।মো. রেজানুর রহমান, চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, আগের পরিকল্পনা অনুসারে ২০২৫ সালে ৫০টি কূপ খনন করা গেলে জাতীয় গ্রিডে দিনে প্রায় ৬৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে। ইতিমধ্যে দিনে ১ কোটি ৮৪ লাখ ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে ৭২ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।
গত ২২ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কূপ খনন নিয়ে একটি সভা করে। সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কূপ খননে গুরুত্ব দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি সভায় বলেন, দেশে গ্যাসের মজুত ক্রমে কমছে, অন্যদিকে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।
দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন টানা কমতে থাকে। এখন এটি ২০০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। আবার চড়া দামের কারণে চাহিদামতো এলএনজি আমদানিও করা যায়নি। ব্যাপক সংকটে পড়ে ২০২২ সালের মাঝামাঝি ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এটিও অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়নি।
সভায় বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা। দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে গুচ্ছ আকারে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। যেখানে গ্যাসের বড় মজুত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেখানে অগ্রাধিকারভিত্তিতে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বাপেক্সের বিদ্যমান রিগ ব্যবহার করে দেশে গ্যাসের বড় মজুত অনুসন্ধান, গভীর কূপ খননের মাধ্যমে মজুত বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এ ছাড়া ৩১টি কূপ সংস্কারে ৫ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ উপকমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন উপদেষ্টা।
এর আগে ৩১টি কূপ সংস্কারের একটি স্পষ্ট সময়সূচিসহ কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও কাজ তদারকি করতে গত ২১ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে পেট্রোবাংলা। ১৫ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন বাপেক্স পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ইসতিয়াক আহমদ। কমিটিতে জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা, বুয়েট ও গ্যাস উৎপাদন কোম্পানির কর্মকর্তারা রয়েছেন।
কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে বলা হয়েছে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ৫০টি কূপের আওতাধীন ১৬টি ও ১০০টি কূপের আওতাধীন ৩১টি কূপ সংস্কারে সময়সূচিসহ পর্যালোচনা, গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাব্যতা এবং দ্রুত পাইপলাইনে সংযুক্ত করার বিবেচনা থেকে কূপ সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা; কূপ সংস্কারের সুফল ও অন্যান্য সম্ভাবনা নির্ধারণ, স্পেসিফিকেশন এবং সংস্কারের যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহার পর্যালোচনা করবে। এর বাইরে রয়েছে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ মিলে দুই পরিকল্পনায় থাকা ৩৪টি ও ৬৯টি কূপ খননে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা। ৩০ দিনের মধ্যে কমিটি একটি প্রতিবেদন জমা দেবে পেট্রোবাংলার কাছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ একটা পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কূপ সংস্কারে জোর দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৬টি কূপ সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি কূপের কাজ শেষে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সব কটি শেষ হলে উৎপাদন আরও বাড়বে। এখন কূপ খননের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্রুত অনুমোদন করে দিচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করে মোটামুটি সামলানো হচ্ছিল কয়েক বছর ধরে। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাস থেকে আসত ২২০ কোটি ঘনফুট। আর বাকিটা এলএনজি আমদানি করে মেটানো হতো। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন টানা কমতে থাকে। এখন এটি ২০০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। আবার চড়া দামের কারণে চাহিদামতো এলএনজি আমদানিও করা যায়নি। ব্যাপক সংকটে পড়ে ২০২২ সালের মাঝামাঝি ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এটিও অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিয়ে কূপ খননের কাজ হাতে নিয়েছে। আগামী বছর থেকে আরও ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস–সংকট সমাধানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ সংস্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটিয়ে পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে দেশের স্থলে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর তৎপরতা চালাতে হবে।