২৮০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচায় কিনতে হচ্ছে ১২ কেজির এলপিজি
রান্না করছিলেন রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা সাহানা সাত্তার। হঠাৎ সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ। সব সময় যে দোকান থেকে গ্যাস কেনেন, তাদের ফোন দেন। দোকানদার ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম চান দেড় হাজার টাকা। দোকানি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২৮০ টাকা বেশি চাইলেও বাধ্য হয়ে এ দামেই নতুন সিলিন্ডার কেনেন সাহানা। গতকাল শুক্রবারের ঘটনা এটি।
সাহানা সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দোকানদারকে সরকারি দামের কথা বলেছিলাম। সে বলে, এগুলো কাগজে-কলমের দাম। তাদের নাকি এখন সিলিন্ডার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আগের মাসেও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৫০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে।’
সরকার প্রতি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেয়। ২ আগস্ট চলতি মাসের জন্য এলপিজির নতুন দাম ঘোষণা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ১২ কেজির সিলিন্ডারের এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ২১৯ টাকা। গত মাসে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ২৫৪ টাকা।
তবে রাজধানীর মিরপুর-১২, ভাষানটেক, কল্যাণপুর ও দক্ষিণখান এলাকার গ্রাহক ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৫০ থেকে ২৮০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ব্র্যান্ডভেদে সিলিন্ডারের দাম কম-বেশি হচ্ছে।
রাজধানীর দক্ষিণ পীরেরবাগ আমতলা এলাকার এলপিজি বিক্রির দোকান গ্রিন হাউজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। কোম্পানির কাছ থেকে ডিলারদের সিলিন্ডার নিতে হচ্ছে বেশি দামে। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিদিনই দাম নিয়ে হট্টগোল হচ্ছে।’
মিরপুর ১২ নম্বরের সিলিন্ডার পয়েন্টের বিক্রেতা মো. ফয়সাল বলেন, ‘বাসাবাড়িতে সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত ৫০ টাকা বেশি নেওয়া হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। গ্যাস–সংকটের কথা বলে কোম্পানিই বেশি দাম রাখছে। ডিজেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলপিজি সরবরাহ করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তারা কর্তৃপক্ষের দাম মানতে বাধ্য। দাম না মানলে তা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় । প্রতি মাসে এলপিজির এই দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের তেল কোম্পানি আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এ সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত বছরের ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে এই সংস্থা। এর পর থেকে প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি করতে না পারার পেছনে বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে। বিইআরসি এলপিজির দাম নির্ধারণে ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে (এলসি সেটেলমেন্ট) ডলারের দাম ধরেছে ৯৮ টাকা। বাস্তবে এলসিতে ডলারে দাম পড়ছে ১০৮ টাকার বেশি। বিইআরসি পরিবহন খরচে ডিজেলের দাম ধরছে ৬৫ টাকা লিটার। বাস্তবে ডিজেলের দাম এখন ১১৪ টাকা লিটার। এ ছাড়া বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করে এলপিজির দাম যৌক্তিকভাবে নির্ধারণে বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
বসুন্ধরা এলপিজির হেড অব ডিভিশন (সেলস) জাকারিয়া জালাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক বছর নির্ধারিত দামে বিক্রি করা গেলে এখন কেন বিক্রি করা যাচ্ছে না? নিয়মের বাইরে বিক্রি করে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা হওয়ার তো ইচ্ছা নেই। যেসব কারণ উল্লেখ করে বিইআরসিকে যৌক্তিকভাবে দাম বাড়াতে বলা হয়েছে, সেটি নিয়ে শুনানিও হচ্ছে না।
দেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে গৃহস্থালিতে গ্যাস-সংযোগ বন্ধ। এ সময় বেড়েছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। তাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দিকে ঝুঁকছেন মানুষ। গ্রামে–গঞ্জে এখন রান্নায় মাটির চুলার বদলে জায়গা করে নিয়েছে এলপিজি। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মধ্যেই আছে অসন্তুষ্টি।
নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি না হওয়ার বিষয়ে বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, সারা দেশে হুবহু বিইআরসির নির্ধারিত দামেই এলপিজি বিক্রি হয়, এটা বলা যাবে না। কিন্তু ভোক্তাদের দায়ও অনেক। ভোক্তারা দোকান থেকে রসিদ নিতে চান না। ভোক্তাদের অবশ্যই দোকানদারদের কাছ থেকে রসিদ নিতে হবে।
বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাসায় পৌঁছে দেওয়ার নামে বেশি টাকা আদায় করে থাকে।
ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইল, দিনাজপুর ও মাদারীপুরের চিত্রও একই। ওই সব এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, সেখানেও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার।
দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়া এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার গতকাল শুক্রবার সকালে ১২ কেজির একটি এলপিজি সিলিন্ডার কিনেছেন। তাঁর কাছে দোকানদার দাম রেখেছেন ১ হাজার ৪০০ টাকা। গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ায় এই দামেই তিনি কিনতে বাধ্য হয়েছেন।
মাদারীপুর পৌর এলাকার এলপিজি ব্যবসায়ী সাইদুর ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘১২ কেজির সিলিন্ডার ১ হাজার ৩৮০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি।’
প্রতিবারই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি আমলে নিয়ে বিইআরসি এলপিজির দাম নির্ধারণ করে বলে মন্তব্য করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলপিজি সরবরাহ করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তারা কর্তৃপক্ষের দাম মানতে বাধ্য। দাম না মানলে তা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর আগেও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিইআরসিকে বলা হয়েছে, কিন্তু নেওয়া হয়নি।