গ্যাস অপচয়-চুরিতে ক্ষতি ১০০ কোটি ডলার
বিগত তিন বছর (২০২০, ২০২১, ২০২২) গ্যাস খাতে গড়ে কারিগরি ক্ষতি (সিস্টেম লস) হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। গ্যাস সরবরাহে অপচয়ের পাশাপাশি চুরিও হয়। শিল্পও চুরির গ্যাস ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে বেশি চুরি হয় আবাসিক খাতে। ৫ শতাংশ চুরি কমিয়ে শিল্পে সরবরাহ করা হলে চলমান গ্যাস–সংকট কেটে যায়। গ্যাসের চুরি রোধে অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নিয়ে দেখাবে।
‘বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংস্কারে চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে আয়োজিত সেমিনারের মূল নিবন্ধে আজ বুধবার এ কথা বলা হয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) ও পাক্ষিক পত্রিকা এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে বলা হয়, দাম দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার পর চুরি ও অপচয় হচ্ছে। প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ১২ ডলার ধরলে বছরে ১০০ কোটি ডলার (১২ হাজার কোটি টাকা) ক্ষতি হচ্ছে।
নিবন্ধে বলা হয়, গ্যাস খাতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অপচয় মানা যায় আন্তর্জাতিকভাবে। বাংলাদেশের জন্য এটি বড়জোর ৫ শতাংশ হতে পারে। তাই গ্যাস চুরি বন্ধ করতেই হবে। দেশে গ্যাসের মজুত কমে আসার কারণেই তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে গেছে গত সরকার। এরপর সংকট সমাধানে কিছু করা হয়নি। বরং রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অব্যাহত রাখা হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, ২০০৫-০৬ থেকে দেশে প্রচণ্ড লোডশেডিং শুরু হয়। ২০০৭ সালে বোঝা গেল গ্যাস–সংকট। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত বিদ্যুৎ আনতে তেলভিত্তিক ১০টি রেন্টাল চুক্তি করা হয় ক্যাপাসিটি পেমেন্ট (কেন্দ্র ভাড়া) দিয়ে। তবে দরপত্র ডেকে করা হয়েছিল। আসলে কেন্দ্র ভাড়া কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে অব্যবহৃত কেন্দ্র ভাড়া। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতার কারণে বসিয়ে রেখে ভাড়া দিতে হচ্ছে।
এখন বর্তমান সরকারের কাছে প্রত্যাশা বেশি বলে উল্লেখ করে ম তামিম বলেন, শিগগির সব সমাধান হবে না, একটু সময় লাগবে। জ্বালানি খাতে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া ও দুর্নীতি প্রভাব রেখেছে। বিদ্যুৎ জ্বালানির সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে করা ঠিক হয়নি, এটা কারিগরিভাবে দেখা উচিত ছিল। সন্ত্রাস সব ক্ষেত্রে হয়েছে। গ্যাস নেই জেনেও কেন্দ্র করা হয়েছে, এর দায় এখন বহন করতে হবে। নতুন করে যেন ভুল না হয়। তাই ভেবে এগোতে হবে।
নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, ২০৩০ সালে দিনে গ্যাসের চাহিদা হবে ৫০০ কোটি ঘনফুট। ওই সময়ের মধ্যে পরিকল্পনা অনুসারে তিনটি নতুন টার্মিনাল করা গেলে ৫৫৩ থেকে ৬১৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির সক্ষমতা তৈরি হবে। তবে আমদানির জন্য ডলার লাগবে। জ্বালানি খাতে ইতিমধ্যে কত বড় বোঝা তৈরি হয়েছে, কিছুদিন পরই অন্তর্বর্তী সরকার টের পাবে।
নিবন্ধ বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উৎপাদন হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। ওই সময় উৎপাদন হয়েছে ৯৭২ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এর পর থেকে প্রতিবছর উৎপাদন কমছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে ৮০৩ বিসিএফ। গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হলে বছরে অন্তত ১০টি কূপ খনন করতে হবে। এতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমাতে হবে। দেশে উৎপাদন না করে সার আমদানি করা যেতে পারে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে শিল্পে কয়লা, এলপিজি, জ্বালানি তেল ও জ্বালানি কাঠ বিবেচনা করতে পারে সরকার।
বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, দরপত্র ছাড়া একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হয়েছে। কেউ একটা ছক্কা মারল, বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে দিল। কেউ সেঞ্চুরি করল, বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে দিল। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এত দামে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল দিতে হতো না ভোক্তাকে। পাকিস্তানের মতো দেশেও বিদ্যুৎ চুক্তির অনিয়ম যাচাই করে দেখা উচিত।
বিটিএমএর পরিচালক রাজীব হায়দার বলেন, কেউ নিচ্ছে কেন্দ্র ভাড়া, কেউ করছে চুরি। আর দায় নিচ্ছে শিল্প। গত দেড় দশকে শিল্পে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৬০ শতাংশ। গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভারের কারখানার সক্ষমতা ৪০ শতাংশ অব্যবহৃত। তাই দ্রুত সমাধান দরকার। গ্যাস দিতে না পারলে মূল্য যৌক্তিক করা হোক। প্রতি ইউনিট ৩১ টাকা দিয়ে শিল্প টিকবে না।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন আইবিএফবির সভাপতি হুমায়ূন রশীদ। সেমিনার সঞ্চালন করেন এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন।