বসন্তের ‘ড্রেস রিহার্সাল’

একুশে বইমেলা
ফাইল ছবি

‘নিয়ে যান...পঞ্চাশ...পঞ্চাশ...এই যে নিয়ে যান না...’

কান আটকে গেল ‘নিয়ে যান না...’ শব্দটিতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি প্রান্তের প্রবেশপথে অনেকগুলো ফুলের টায়রা হাতে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হরদম চিৎকার করছেন মামুন। কেমন যেন একটা আকুতি ঝরে পড়ছে কণ্ঠে। তাঁর এই আকুতিতে মজে অনেকেই সঙ্গীর জন্য ফুলের টায়রা কিনছেন, কেউবা ময়মনসিংহ থেকে কাজের সন্ধানে আসা এই তরুণকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন বইমেলার ভিড়ভাট্টায়।

এমনই এক ‘জুটি’ মোদাব্বির ও তনুজা। তাঁদের সঙ্গে বাতচিতের প্রথমেই এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তরুণ প্রকৌশলী মোদাব্বির বন্ধু তনুজার মাথায় ফুলের টায়রা পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘মেলায় ঘুরে ঘুরে আজ বই বাছাই করব, কিনব পয়লা ফাল্গুনে। বসন্তের প্রথম দিন তনুজাকে তাঁর পছন্দের লেখকদের বই উপহার দেব। আজ আসলে আমাদের ড্রেস রিহার্সাল।’

গতকাল মাঘের শেষ সময়ের বিকেলে বইমেলায় বসন্তের ‘ড্রেস রিহার্সাল’ চলছিল পুরোদমে। অগণিত তরুণীর মাথায় ফুলের টায়রা আর বাসন্তী বাতাস ফাল্গুন আসার দুই দিন আগেই যেন জানান দিচ্ছিল, ‘বসন্ত আসিতেছে’!

প্রকৃতিতে যেমন ফাগুন হাওয়ার তান, তেমনি মেলার মাঠে বিক্রিবাট্টার ক্ষেত্রেও এখন আসি আসি করছে বসন্ত—অন্তত বিভিন্ন স্টলের প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমনই আভাস মিলল। রোববার মেলার ১২তম দিনে সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদের কণ্ঠে যেমন শোনা গেল, ‘শুরু থেকেই এবার ভালো বিক্রি হচ্ছে। গত শুক্র-শনিবারে বলার মতো বিক্রি হয়েছে অনেকের। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে ভালো বিক্রি হবে বলে আশা করি। এখনো সবাই আসলে বই বাছাই করছেন।’

সময় প্রকাশন থেকে এবার শওকত ওসমানের অগ্রন্থিত কিছু লেখা নিয়ে ওদিকে যেতে চাই নামে একটি বই বের হয়েছে।

অনেকের মতে, ফিকশনের চেয়ে এখন নন-ফিকশনের দিকেই পাঠক বেশি। কথাটির সত্যতা মিলল প্রথমার প্যাভিলিয়নে ঢুঁ দিয়ে।

ভিড় উজিয়ে প্রথমার প্যাভিলিয়নের এক কোণে দুই মধ্যবয়সী পাঠকের সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁরা পরস্পর বন্ধু। কথা প্রসঙ্গে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ, অভ্যুত্থান পাল্টা–অভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়-আশয় নিয়ে প্রথমা যেসব বই করে, তা তথ্যমূলক ও নির্ভুল। যে কারণে এসব বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমাই তাঁদের প্রধান ভরসা।

আর প্রথমার নির্বাহী (বিতরণ) ইব্রাহীম হোসেন বললেন, ‘নন-ফিকশন বইয়ের চাহিদা এখানে বেশি। তবে আমাদের প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের বিক্রিও নেহাত কম নয়। জহির রায়হানের গল্পের নতুন বইটা (যখন যন্ত্রণা) তো প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি আনিসুল হকের উপন্যাস পারিজাতের জন্য ভালোবাসা, আফসানা বেগমের গল্পের বই দহনদিনের বীণা, মাহবুব তালুকদারের ছড়াসমগ্র—এগুলোর বিক্রিও খারাপ নয়।’ সন্ধ্যায় ইব্রাহীম যখন কথাগুলো বলছিলেন, প্রথমার প্যাভিলিয়নে বসে বইয়ে স্বাক্ষর দিতে দিতে তখন পাঠকের সেলফির আবদার মেটাচ্ছিলেন আনিসুল হক। ঢাকা কলেজে পড়া এক তরুণকে বইয়ে স্বাক্ষর দেওয়ার ফাঁকে তিনি বললেন, ‘বইয়ের চেয়ে ভালো উপহার আর হয় না, আসছে বসন্তের দিনে আমরা যদি একে অপরকে ভালোবেসে বই উপহার দিই, কতই–না ভালো হয়!’

কথাটি মা উপন্যাসের এই লেখক যে একা বললেন, তা নয়। পুঁথিনিলয় প্রকাশনীতে বসে প্রায় একই কথা বললেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূসমেত মেলায় এসেছিলেন তিনি। বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন, তাঁর পুত্রবধূ মাইশা আজফার এবার জনপ্রিয় কনভারসেশন উইথ গড বইটি অনুবাদ করেছেন। ঈশ্বরের সাথে কথপোকথন নামে এটি গতকাল প্রকাশিত হয়েছে ঐতিহ্য থেকে। আর জার্নিম্যান বুকস থেকে মেলায় এসেছে কবি তারিক সুজাতের কাব্যগ্রন্থ বেভেরিয়া কবিতাগুচ্ছ। এই বই হাতে সন্ধ্যায় যখন ফিরছি, মেলার মাঠে দেখা হলো একদল তরুণ কবির সঙ্গে। কথায়–কথায় এই দলের একজন সগৌরবে উচ্চারণ করলেন, বসন্তের প্রথম দিনে তিনি প্রেমিকাকে ফুল নয়, কোনো প্রিয় কবির কবিতার বই উপহার দেবেন।

তাঁদের কথা শুনে আবারও মন বলল, শীতের শেষে, ‘বসন্তের ড্রেস রিহার্সালে’ কেউ দেখি কম যান না!