স্বৈরাচার যেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের হাতিয়ার করেছিল

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারাই ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়ছবি: অমিয় তরফদার

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনার ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশের আধিপত্যশীল প্রায় সব বয়ানের ঐক্যমত রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বাকি দল ও নেতাদের অবদানকে খাটো করে এবং আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গিতেই ইতিহাসচর্চার প্রবণতা ১৯৯০-এর দশক থেকে শক্তিশালী হতে শুরু করে। এই দশকের মাঝামাঝি, বিশেষত আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ পাবলিক ডিসকোর্সের অংশ হতে শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে যা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক কসরতের মামলা, ২০০৮–০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সেটি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপ্রণোদিত প্রকল্প হিসেবে হাজির হতে শুরু করে।

এই রাষ্ট্রীয় প্রকল্প মুক্তিযুদ্ধের আরও সংকীর্ণ বয়ান হাজির করল। মুক্তিযুদ্ধকে কেবল দলীয় নয়, বরং পরিবারের মামলায় পরিণত করল। আওয়ামী লীগের এই বয়ান—যা কিনা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রধান মতাদর্শিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল—তা গড়ে উঠেছিল প্রধানত দুটো তরিকায়: ইতিহাসচর্চায় আইন ও আদালতের হস্তক্ষেপে এবং আর্কাইভের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যের মাধ্যমে। দুটো বিষয় একটু খোলাসা করা যাক।

প্রথম তরিকা ব্যাখ্যার জন্য আমরা দুটো উদাহরণ নিতে পারি। প্রথমেই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই উপন্যাসের দুটি অধ্যায়ে শেখ রাসেলের হত্যাদৃশ্যের যে বিবরণ দেওয়া হয়, তাতে আপত্তি জানিয়ে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। আদালত পরে দেয়াল উপন্যাস প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, ‘আদালত আশা প্রকাশ করেছে যে বইটির তথ্যগত ভুল সংশোধন করা হবে।’ আবার এ–ও উল্লেখ করা হয় যে ‘আদালতের আশা প্রকাশও আদেশ হিসেবে গণ্য।’

 ‘আশা’র ছদ্মবেশে আদালতের ‘আদেশ’-এর মূল কারণ হচ্ছে, ‘হুমায়ূন আহমেদের ওই উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার সময় শেখ রাসেলের মৃত্যুর দৃশ্যপটটি যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। এ হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি বীভৎস ঘটনা। কিন্তু হুমায়ূনের বিবরণে সেটা ফুটে ওঠেনি।’ আদালত চান না, ‘নতুন প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জানুক।’

এই ঘটনা, আমাদের বিবেচনায় দুটো জায়গা থেকে, খুবই গুরুতর। প্রথমত, আদালত সরাসরি এখানে উপন্যাস বা গল্প বা ফিকশন রচনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন। যতই বাস্তব বা ঐতিহাসিক ঘটনার ভিত্তিতে একটি উপন্যাস রচিত হোক, সেটা উপন্যাসই, কোনোভাবেই ইতিহাসের গ্রন্থ নয়। দ্বিতীয়ত, কথাসাহিত্যের জগতেও আদালতের এমন হস্তক্ষেপ পড়েছিল, তাদের ভাষ্যমতে, নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর খায়েশ থেকে। ইতিহাস জানানোর খায়েশ এবং ইতিহাসের সঠিক–ভুল নির্ধারণের ভার আদালতের হাতে ন্যস্ত হওয়া—দুটোই ইতিহাসচর্চা, জ্ঞানচর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

এই ঘটনাকে প্রাথমিক নজির হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে, যেখানে আদালত সঠিক ইতিহাসের নাম করে একজন কথাসাহিত্যিকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এ ঘটনার মূলে ছিল আদতে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের চিত্রায়ণ। অর্থাৎ, আদালতের হস্তক্ষেপ ও ভাষ্য এমন পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে, একজন কথাসাহিত্যিক শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার–সম্পর্কিত একটা ঘটনাকে কীভাবে চিত্রায়ণ করবেন, সেটাও ঠিক করার এখতিয়ার নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় অঙ্গাদি।

দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা। ইতিহাসের সঠিক–বেঠিক নির্ধারণের দায়ভার যে আদালত নিয়েছিলেন, সেটা যে চিত্রায়ণের সমস্যাতেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং অন্যান্য বিষয়ও যে দ্রুত এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের ঘটনা থেকে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বার্গম্যানকে যেমন আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, তেমনি ‘ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত’ বিষয় নিয়ে তর্ক না করার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়। এই সতর্কবার্তা থেকে ‘ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত’ ঘটনার বিষয়ে বাহাসে নিরুৎসাহিত করতে আদালতের খায়েশ স্পষ্টত ধরা পড়ে।

কথাসাহিত্য এবং ঐতিহাসিক তর্কে ‘ইতিহাস’-এর সূত্র ধরে আদালতের এমন হস্তক্ষেপের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবকে নিয়ে এমন কিছু সংযুক্ত করেছিল, তাতে মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিব বিষয়ে আওয়ামী বয়ানের বাইরে যেকোনো ধরনের পর্যালোচনামূলক আলাপকে ফৌজদারি অপরাধে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। এই আইনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ খুবই অস্পষ্ট ও বায়বীয় শব্দ, যার মধ্যে শাসকদের ইচ্ছেমতো যেকোনো কিছুই গুঁজে দেওয়া সম্ভব ছিল। আইনের মধ্যে এমন এক অস্পষ্ট বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আধিপত্যশীল ও ক্ষমতাসীন বয়ানের বাইরে প্রায় সব আলাপকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র বরখেলাপ বলে চিহ্নিত করার এখতিয়ার দিয়েছিল।

এমন ভয়াবহ আইনের উপস্থিতির পাশাপাশি সংসদ থেকে শুরু করে মাঠ পর্যন্ত আওয়ামী নেতা–কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে নতুন আইন প্রণয়নের জন্য আলাপ-আলোচনা জারি ছিল। আদালতের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন জনমনে সেলফ-সেন্সরশিপের অনুভূতি তৈরি করেছিল। এই পরিস্থিতি একদিকে আধিপত্যশীল বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অথবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো ধরনের পর্যালোচনামূলক আলাপ-আলোচনার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিয়েছিল, অন্যদিকে রাষ্ট্রপ্রণোদিত বয়ান ব্যাপকভাবে প্রচারের অনুকূল পরিবেশও তৈরি করেছিল।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় তরিকায়: আর্কাইভের নির্বাচিত উন্মুক্তকরণ। আর্কাইভকে কেবল সংগ্রহশালা অথবা ‘অতীত’–সংক্রান্ত তথ্যের ভান্ডার বললে যতটা নিরীহ, নির্মোহ ও রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে প্রতীয়মান হয়, আদতে তা ততটা নয়। আর্কাইভের কোন তথ্য কখন উন্মুক্ত করবেন, কোন তথ্য কখন লুকাবেন, কোনটা সামনে নিয়ে আসবেন, কোনটাকে আড়াল করবেন, কোন স্মৃতিকে বিস্মৃতির সাগরে তলিয়ে দেবেন, কোন তথ্যের কোন অর্থ প্রদান করবেন—এগুলো মূলত ক্ষমতাসীনেরাই নির্ধারণ করে দেন। ফলে এটাকে কেবল পুরোনো দলিলের ভান্ডার হিসেবে বিবেচনা না করে ইতিহাস ও রাজনীতির এক লীলাভূমি হিসেবেই চিহ্নিত করা শ্রেয়।

বিগত আওয়ামী শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের শেখ মুজিবকেন্দ্রিক বয়ান তৈরি এবং শেখ মুজিবের ওপর ‘দেবত্ব’ আরোপের মতো পরিস্থিতি তৈরিতে একটি দ্বৈত প্রক্রিয়ায় আর্কাইভকে ব্যবহার করা হয়েছে। একদিকে শেখ মুজিব–সম্পর্কিত গোপন নথি বেছে বেছে প্রকাশ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে অন্য নেতাদের সম্পর্কিত নথিপত্র ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এর একটা নজির হতে পারে সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

শেখ হাসিনার সম্পাদনায় প্রকাশিত গোয়েন্দা শাখার এই নথিগুলোর প্রকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আসলে গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবকে নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনগুলো প্রায় ১৪ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। কীভাবে বা কোন পদ্ধতিতে গোপন দলিলগুলোকে ডি-ক্লাসিফায়েড করা হলো, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি এবং এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ডও পাওয়া যায় না।

এই সংকলনের ভূমিকায় শেখ হাসিনা এমন একটি ধারণা তৈরির কোশেশ করেছেন যে শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো নেতার ওপর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এত ব্যাপক নজরদারি করেনি। গোয়েন্দা রিপোর্টের আপাত এই তারতম্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা আসলে মুজিবের সক্রিয়তা ও অন্যদের নিষ্ক্রিয়তার দিকে আঙুল তোলেন। অর্থাৎ, কেবল শেখ মুজিবই ছিলেন এমন নেতা, যাঁর ওপর গোপন গোয়েন্দা নজরদারি ছিল, বাকিরা এমন নজরদারির আওতামুক্ত ছিলেন। ফলে পাকিস্তান সরকারের কাছে কেবল শেখ মুজিবই ছিলেন মূল ‘শত্রু’। এর বিপরীত অর্থ হলো তিনিই ছিলেন একমাত্র ‘স্বাধীনতাকামী’। একাত্তরের আরও বহু দলিল দিয়ে এই ধারণাকে আসলে প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব, অথবা বলা যায় গোয়েন্দা সংস্থা কেবল মুজিবকে নিয়ে রিপোর্ট করেছে এবং মাওলানা ভাসানী বা সোহরাওয়ার্দী বা মণি সিংহদের নিয়ে খুব একটা রিপোর্ট করেনি বা নজরদারি করেনি, তা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলের একমাত্র স্বাধীনতাকামী নেতা ছিলেন—এই আখ্যানের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল বাদবাকি সব নেতার ভূমিকা, এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকাও। আবার এই দলিলগুলোর আদিরূপও যাচাই করা সম্ভব নয়, কেননা আর্কাইভে নাগরিকের অভিগম্যতা নেই। অন্যদিকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের অস্বস্তিকর পর্ব—১৯৭১ থেকে ১৯৭৫—নিয়ে আর্কাইভে ছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। একদিকে বাছাইকৃত দলিলাদি উন্মুক্তকরণ এবং কিছু দলিলে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপণ; অন্যদিকে আর্কাইভে জনগণের অভিগম্যতা না থাকা—এর মাধ্যমেই ইতিহাস ও আখ্যান নির্মাণে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল ক্ষমতাসীনেরা।

মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যখন অন্যদের উপেক্ষা করে কেবল একক কোনো ব্যক্তির দলিলাদি প্রকাশ করা হয়, তখন সেই ‘সত্য’ তথ্য দিয়ে কেবল একটি বিশেষ বয়ান–আখ্যান নির্মিত হয়। এই ইতিহাস তখন সামূহিক হয় না, রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় দলীয় বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাসই রচিত হয়।

আইন ও আদালতের অপব্যবহার এবং আর্কাইভের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের যে আখ্যান আওয়ামী লীগ নির্মাণ করেছে, তাতে ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃতিও সমানভাবে হাজির ছিল। শেখ মুজিবকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে অন্য নেতাদের হেয় করা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। মাওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান—সবাই ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের মাধ্যমে অবমাননার শিকার হয়েছেন।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের খাটো করে উপস্থাপন করার মধ্যেই এই প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ ছিল না। এই বয়ান এতটাই শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল যে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকাও উপেক্ষিত হওয়া শুরু হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় ইতিহাসও একটি সমষ্টিগত বর্ণনা থেকে ক্রমশ পরিবারকেন্দ্রিক ইতিহাসের পরিণত হয়েছিল। জাতীয় ইতিহাসকে শেখ পরিবারের কেন্দ্রস্থলে রেখে পুনর্গঠিত করার ফলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীও জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে শারমিন আহমদ নেতা ও পিতা গ্রন্থ লেখার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এবং ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের চাকরিচ্যুতি এর উজ্জ্বল নজির। এমনকি ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে শেখ মুজিবও রেহাই পাননি। উদাহরণ হচ্ছে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাষণসমগ্র, যার ভূমিকা লিখেছেন শেখ হাসিনা। এখানে মুজিবের বক্তৃতার বিকৃতিও ঘটানো হয়েছিল। অর্থাৎ, এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, আওয়ামী লীগের হাতে খোদ আওয়ামী লীগের সঠিক ইতিহাস, ভূমিকা বা শেখ মুজিবের ইতিহাসও লেখা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

বিগত আওয়ামী শাসনামল দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি সংকীর্ণ বয়ানের ওপর ভিত্তি করে তাঁদের স্বৈরতন্ত্রের মতাদর্শ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করেছে। এই মতাদর্শিক নির্মাণ সম্ভব হয়ে উঠেছে আইন ও আদালতের অপব্যবহার এবং আর্কাইভের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।

এই দুই তরিকা এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর তৈরি করেছিল, যা একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাকে নিরুৎসাহিত করেছিল এবং অন্যদিকে এর প্রচারকে লাভজনক হিসেবে হাজির করেছিল। এর ফলে ঐতিহাসিক তথ্যের ধারাবাহিক নির্মিতি ও বিকৃতি ঘটেছিল। বিরোধী যেকোনো মতামতকে ‘অদেশপ্রেমিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিন্দা করা হচ্ছিল, যা সেলফ-সেন্সরশিপের আবহ তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে যে বয়ান ও মতাদর্শ নির্মিত হয়েছিল, সেটাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে আওয়ামী শাসক দল মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ বয়ানকে তাদের মতাদর্শ হিসেবে নির্মাণ করে যেভাবে ‘দেশপ্রেম’কে বিভাজন তৈরির অস্ত্র ও ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেটা সমসাময়িক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অন্যান্য নজিরের থেকে খুব একটা পৃথক কিছু নয়। ইতিমধ্যে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, এই জমানার স্বৈরাচারেরা ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে তাঁদের শাসনকে জায়েজ করার চেষ্টা করেন।

স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়ে মুক্তিসংগ্রামের একটি আখ্যান কীভাবে পরিণত হয়েছিল নিপীড়নের হাতিয়ারে: এই ট্র্যাজেডি ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাস্বরূপও। যেকোনো আন্দোলন, তা যতই মহান আদর্শেই পরিচালিত হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় সেটিও নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। আন্দোলন-সংগ্রাম তথা ইতিহাসের চালকের আসনে জনগোষ্ঠীর সক্রিয়তা ছাড়া যদি ব্যক্তিকে বসানো হয়, তবে তা ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতান্ত্রিক মতাদর্শের জমিন তৈরি করে।