ভবিষ্যতে সংঘাত ঠেকাতে শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ডিএমপি

দুর্বলতা ও করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে ডিএমপির আট অপরাধ বিভাগকে নির্দেশনা।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)ছবি: ডিএমপির ফেসবুক থেকে নেওয়া

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষ ও সংঘাতে পুলিশ কতগুলো সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ব্যবহার করেছে, তার হিসাব প্রস্তুত করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা মোকাবিলায় আরও জনবল, রসদ ও সরঞ্জাম (লজিস্টিকস) যুক্ত করে শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

ডিএমপি সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে বড় ইউনিট ডিএমপিতে এখন ৩০ হাজার ২০০ পুলিশ সদস্য আছেন। এর মধ্যে অর্ধেক পুলিশ সদস্য মাঠে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করেন। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো ভবিষ্যতেও এ ধরনের আন্দোলন হতে পারে। তাই এখন থেকেই পুরো পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

ডিএমপিকে শক্তিশালী করতে হলে শুধু ফোর্স ও রসদ বাড়িয়ে লাভ হবে না। বরং যে ফোর্স আছে, তার সঠিক তদারকি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নূর মোহাম্মদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক

ডিএমপির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের প্রতি পুলিশ প্রথমে নমনীয় ছিল। এ সুযোগে ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপি-জামায়াত। পরে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ কারণে পুলিশ বেশি আক্রান্ত হয়েছে।

ওই কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীদের তুলনায় মাঠে পুলিশ সদস্য ছিলেন কম। তাই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে ও নিজেদের রক্ষা করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁদের।

ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, সংঘর্ষ যতক্ষণ কয়েকটি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ততক্ষণ পুলিশের জন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সংঘাত যখন ঢাকার বিভিন্ন স্থান ও অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা মোকাবিলা করা পুলিশের জন্য একপ্রকার দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

ডিএমপির একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিরোধে দুর্বলতা কী ছিল, ভবিষ্যতে কী করণীয়, সে বিষয়ে রোববার ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারকে মূল্যায়ন করতে বলেছে অপারেশনস বিভাগ। সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারকে তাঁর ‘ঝামেলাপূর্ণ স্থান’ চিহ্নিত করে সেখানে কতসংখ্যক পুলিশ সদস্য, কী পরিমাণ অস্ত্র-গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি দরকার, তার তালিকা করে ডিএমপি সদর দপ্তরে পাঠাতে বলা হয়েছে। ডিএমপির ওই চাহিদাপত্র পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) মঞ্জুরি পাওয়া সাপেক্ষে জনবল ও বাড়তি রসদ ডিএমপিতে যুক্ত হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে রাজধানীতে সংঘাত ঠেকাতে মাঠপর্যায়ে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের কাছে কোনো আগাম তথ্য ও পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। হামলার সম্ভাব্য স্থানগুলো তারা আগে থেকে চিহ্নিত করতে পারেনি।

জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিএমপির প্রতিটি ইউনিটকে আরও বেশি শক্তিশালী করার জন্য যা যা করার দরকার, সেই ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে।

সংঘাত ঠেকাতে মাঠপর্যায়ে পরিকল্পনা ছিল না—একাধিক পদস্থ কর্মকর্তার এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘাত ঠেকাতে পরিকল্পনা সাজিয়েই মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা।’

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে। এর পরদিন থেকে এ আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য বিজিবি নামানো হয়। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ঢাকায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মেট্রো রেলস্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু ভবন, বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়, পুরোনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভিন্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও গাড়ি ভাঙচুর করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সংঘাত, ভাঙচুর, আগুনে বাড়তে থাকে হতাহতের সংখ্যা। ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করে নামানো হয় সেনাবাহিনী।

জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে ঢাকায় সহিংসতা ও সহিংস ঘটনার স্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। তাই পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি চালিয়ে হত্যা করার পর সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।

পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা মনে করেন, ডিএমপিকে শক্তিশালী করতে হলে শুধু ফোর্স ও রসদ বাড়িয়ে লাভ হবে না। বরং যে ফোর্স আছে, তার সঠিক তদারকি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।