পাঁচ মাসে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকারসহ নানা দাবিতে ১০১ আন্দোলন

  • নানা দাবিতে ঢাকায় সড়ক অবরোধের কারণে যানজটে জনদুর্ভোগ।

  • বেশির ভাগ আন্দোলনকারী নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বা ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করছেন।

ঢাকা জেলার সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোকে মহানগরীতে চলাচলের অনুমতি দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ। গতকাল বেইলি রোডেছবি: সাজিদ হোসেন

কে কখন কোন দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বসবেন, এমন একটা আশঙ্কা নিয়ে ঢাকার মানুষকে এখন চলাচল করতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যানারে ব্যস্ত সড়কে হাজির হচ্ছেন কেউ না কেউ। যাঁরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন, তাঁদের বেশির ভাগ নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বা ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করছেন।

কেউ সুনির্দিষ্ট ‘ব্যানার’ নিয়ে আন্দোলন করছেন, আবার কেউ ব্যানার ছাড়াই হঠাৎ সড়কে নেমে বিক্ষোভ করছেন। যেমন গত ২৬ আগস্ট সকালে হঠাৎ শাহবাগ এলাকার সড়ক অবরোধ করেন প্যাডেলচালিত শত শত রিকশাচালক। তাঁদের দাবি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার সড়কে চলতে পারবে না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একের পর এক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক দাবিতে অনেক পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ আন্দোলন শুরু করেছেন।

সেদিন শাহবাগের পাশাপাশি ঢাকার আরও কিছু এলাকার সড়কে নেমেছিলেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকেরা। তবে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় নামলেও সুনির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের ব্যানারে তাঁরা সেদিন জড়ো হননি। যে যাঁর মতো করে এলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে পারবে না ঢাকায়, এটিই ছিল মূল দাবি।

এ ঘটনার আড়াই মাস পর গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের এক নির্দেশনার বিরোধিতা করে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনে নামেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা। তাঁরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সড়ক অবরোধ করে শুরু করেন আন্দোলন। ওই আন্দোলনের মধ্যে ২১ নভেম্বর ঢাকার মহাখালীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা অবশ্য সফল হয়েছেন। রাজধানী ঢাকার মূল সড়কগুলো বাদে অলিগলির সড়কে চলাচলের অনুমতি আদায় করতে পেরেছেন তাঁরা। যদিও মূল সড়কেও এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা যাচ্ছে।

সড়ক অবরোধের ঘটনা গতকাল রোববারও ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। দুপুরের দিকে হঠাৎ মগবাজার মোড়ের কাছে অফিসার্স ক্লাব–সংলগ্ন প্রধান সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা জেলায় (রাজধানীর বাইরে) চলাচলের নিবন্ধন পাওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকেরা। এতে দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।

চলমান আন্দোলনের মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা। এই দাবিতে ১৫ আগস্ট থেকে জোরদার আন্দোলন শুরু করে চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি অংশ। যদিও একই দাবিতে কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চলছে।

অবরোধকারীদের দাবি, ঢাকা জেলায় চলাচলের জন্য নিবন্ধিত অটোরিকশাও রাজধানীর সড়কে চলাচলের সুযোগ দিতে হবে। প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধের পর সড়ক ছেড়ে যান তাঁরা। ঢাকা জেলা সিএনজি অটোরিকশা মালিক-শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটির ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একের পর এক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক দাবিতে অনেক পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-আন্দোলন করায় ঢাকার যানজট আরও তীব্র হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি-কষ্ট বাড়ছে। সরকারি কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে।

ছোট-বড় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত গত ৫ মাসে অন্তত ১০১টি আন্দোলনের তথ্য পেয়েছে প্রথম আলো। এর মধ্যে অনেক সংগঠন ও গোষ্ঠীর আন্দোলন এখনো চলমান। এমন অনেক সংগঠনের ব্যানারেও আন্দোলন হচ্ছে, যেসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। শুধু দাবি জানানোর জন্য বেশ কিছু সংগঠনের জন্ম হয়েছে। আবার কেউ কেউ কোনো ব্যানার বা সংগঠন ছাড়াই আন্দোলনে নেমেছেন।

কত রকম যে বঞ্চিত। যাকে আমি সারা জীবন জানতাম আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী, সে-ও এসে কেঁদে দেয়—আমিও বঞ্চিত।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল একবারে নাজুক। বিপর্যস্ত অবস্থায় দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যখন কিছুটা গুছিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, তখন একের পর এক যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলন শুরু হওয়ায় সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতি এখনো আছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথম দিকে আন্দোলনকারীরা নানা দাবি নিয়ে জড়ো হতেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন) সামনে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের আরেকটি ‘পছন্দের’ জায়গা হয়ে ওঠে শাহবাগ। নিষেধাজ্ঞার কারণে যমুনার সামনে এখন কেউ কর্মসূচি পালন করতে না পারায় শাহবাগের ওপর ‘চাপ’ বেড়েছে। এর আগে কখনো কখনো যমুনার সামনে একসঙ্গে পাঁচ-ছয়টি সংগঠনও নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।

গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দিনে ১৪-১৫টি সংগঠনও রাজপথে নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। যেমন ১৯ আগস্ট ঢাকার বিভিন্ন সড়কের মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে অন্তত ১৭টি সংগঠন। কারও দাবি চাকরি স্থায়ীকরণ, কেউ চায় দুর্নীতি রোধ, কেউবা বৈষম্যের ‘শিকার’, আবার কেউ ‘বঞ্চিত’ দাবি করে সেদিন সড়কে নেমেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। উত্তরা, শাহবাগ, মিরপুর রোড, প্রেসক্লাব, সচিবালয়, রামপুরা, কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক আটকে সেদিন বিক্ষোভ করা হয়েছিল। এর মধ্যে যমুনার সামনে সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করেছিলেন ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের নারীরা। সেদিন নানা আন্দোলনকারীর ভিড়ে বিডিআর থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যদের একটি দল প্রেসক্লাবের সামনে জায়গা না পেয়ে এর বিপরীত পাশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

এমন পরিস্থিতিতে ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সবার সহযোগিতা চেয়ে বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া, লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসংগতভাবে যা কিছু করার, আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে কাজে বাধা দেবেন না।’

প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের পরও সড়ক আটকে আন্দোলন বন্ধ হয়নি। এখন যেসব আন্দোলন চলমান, এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুটি দল রয়েছে। এই দুটি দল আবার মুখোমুখি অবস্থানে আছে। একটি দলে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। অন্য দলে আছেন প্রশাসন বাদে অন্য ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ নামে ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উপসচিব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল, নিজ নিজ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব পদে দায়িত্ব দেওয়া এবং সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছেন।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন করে সাধারণ ছাত্র পরিষদ
ছবি: প্রথম আলো

উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করা হবে, সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ঘোষণার পর প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি করেছেন। দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেন তাঁরা।

চলমান আন্দোলনের মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা। এই দাবিতে ১৫ আগস্ট থেকে জোরদার আন্দোলন শুরু করে চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি অংশ। যদিও একই দাবিতে কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চলছে। এর মধ্যে ৩০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীরা সংগঠিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনের সামনে অবস্থানের চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে ২৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন বহাল রাখা হয়েছে।

নানা নামে নানা সংগঠনের আন্দোলনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিভিন্ন ধরনের দাবি নিয়েই মানুষ আসছে। কেউ পদোন্নতিবঞ্চিত, বেতনবঞ্চিত, কাউকে খারাপ জায়গায় বদলি করা হয়েছে, কারও বেতন বাড়াতে হবে, কাউকে রাজস্ব খাতে নিতে হবে। সবকিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দাবিদাওয়াকেন্দ্রিক। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে কেউ আসে না।

মন্ত্রণালয়ের ৩০ শতাংশ সময় ব্যক্তিগত এসব বিষয়ে ব্যয় হয় উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আরও বলেছিলেন, ‘কত রকম যে বঞ্চিত। যাকে আমি সারা জীবন জানতাম আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী, সে-ও এসে কেঁদে দেয়—আমিও বঞ্চিত।’

নানা ব্যানারে আন্দোলন

ঊর্ধ্বতন-অধস্তন পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য নিরসনসহ ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন অধস্তন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে ১৩ আগস্ট আন্দোলনে নামেন আনসার সদস্যরা। দাবি আদায়ে ২৫ আগস্ট আনসার সদস্যরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সচিবালয় ঘেরাও করেন। সেই রাতে সচিবালয়ের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়।

গত সাড়ে চার মাসে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন করেছেন সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীরা। সবার দাবি, চাকরি স্থায়ী করতে হবে। এমন অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। উল্টো ঘটনাও আছে। সরকারি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের চাকরি স্থায়ী না করার দাবিতে দুটি সংগঠনকে আন্দোলনে নামতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থা বা বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হওয়া ব্যক্তিদেরও আন্দোলনে নামতে দেখা গেছে। এর মধ্যে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাকরিচ্যুত সদস্যরাও চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবি করছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘আয়নাঘরে’ বন্দীদের মুক্তি দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিতের দাবি, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের কারণ নির্ণয়সহ নানা দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনকে মাঠে নামতে দেখা গেছে। রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঝুঁকি ভাতাসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। চাকরিতে বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে আরও অন্তত ৬টি ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছিলেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়
ছবি: প্রথম আলো

পেশাজীবীদের ব্যানারে আন্দোলনে নামা সংগঠনগুলোর মধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ দফা আন্দোলন, রেলওয়ে গেটম্যানদের চাকরি স্থায়ীকরণ আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী গ্রাম-পুলিশ সমন্বয় কমিটি, বাংলাদেশ সচিবালয় বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠন, ইউনিয়ন ও পৌরসভা ডিজিটাল সেন্টার পরিচালক সমন্বয় পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী সার্ভে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ছাত্র পেশাজীবী অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী প্রাথমিক শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ বাংলাদেশ, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কল্যাণ সমিতি ও বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমন্বয় কমিটি, ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ ও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন অন্যতম।

পোশাক কারখানার শ্রমিকেরাও বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চা-শ্রমিকেরাও আন্দোলনে আছেন। সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের দাবিতে সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের আন্দোলন এখনো চলমান। একই দাবিতে আরও কয়েকটি পক্ষ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের সময় তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এক আইনজীবী নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

চলমান আন্দোলনের মধ্যে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর ব্যানারে কিছু মানুষ সড়কে নেমে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলসহ তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। গত ২২ ডিসেম্বর তাঁরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

বিভিন্ন ব্যানারে নানা সংগঠনের দাবি–দাওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, যে কেউ প্রতিবাদ-আন্দোলন করতে পারে, কিন্তু মানুষের চলাচল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি মাথায় রাখা দরকার। আর যেকোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে হুট করে রাস্তায় নামার আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখা উচিত।

পরীক্ষা না দেওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি

বিভিন্ন দাবিতে সড়কে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ২০১৭ সালে। বিভিন্ন সময় এই আন্দোলন কর্মসূচি চলেছে। গত ২৮ ও ২৯ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন। ৬ নভেম্বর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকের পর শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি স্থগিত করেন। তবে এই আন্দোলন আবার নতুন করে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ১৮ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে রেল ও সড়কপথ অবরোধ করে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানান। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ১৯ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করলে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা।

এইচএসসি পরীক্ষা না দেওয়ার আন্দোলন, আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনের ঘটনাও দেখা গেছে। অটোপাসের ফলাফল বের হওয়ার পর যাঁরা পাস করতে পারেননি, তাঁরা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে আন্দোলন করেছেন। দাবি আদায়ে একাধিকবার জোর করে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ার মতো ঘটনাও দেখা গেছে।

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আহত হওয়া ব্যক্তিরাও ক্ষোভ থেকে সড়কে নেমেছিলেন গত ১৩ নভেম্বর। প্রায় ১৪ ঘণ্টা তাঁরা চিকিৎসা না নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।

এইচএসসি পরীক্ষা না দেওয়ার আন্দোলন, আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনের ঘটনাও দেখা গেছে। অটোপাসের ফলাফল বের হওয়ার পর যাঁরা পাস করতে পারেননি, তাঁরা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে আন্দোলন করেছেন। দাবি আদায়ে একাধিকবার জোর করে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ার মতো ঘটনাও দেখা গেছে।

নানা দাবিতে আন্দোলনের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় নানা সীমাবদ্ধতার কারণে যৌক্তিক দাবিও অনেকে প্রকাশ করতে পারেননি। গণ-অভ্যুত্থানের পর তাঁরা মনে করলেন, দাবি প্রকাশের একটি সুযোগ এসেছে। এখন সেটি তাঁরা কাজে লাগাচ্ছেন। তবে অনেক অযৌক্তিক আন্দোলনও হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কারও কারও আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। আবার সরকারকে বিব্রত করতে কেউ কেউ আন্দোলন করছে বলেও অনেকে মনে করছেন।