কয়েকটি বিড়ালের গল্প 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর জন্য মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা যুগ যুগ ধরেই বিদ্যমান। পোষা বিড়ালের ভালোবাসা নিয়ে আমার
এই লেখা। 

প্রথমটি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের এডিনবরা শহরে থাকাকালে আমার ৮৬ বছর বয়সী ল্যান্ড লেডি মিসেস ফ্রেজারের। বাড়াবাড়ি রকমের প্রশ্রয় ও আদর দেওয়া সাদা, খয়েরি রঙের বিড়াল ‘হুইস্কি’। আমি বেজমেন্টের ঘরে থাকতাম। রান্না-খাওয়ার জন্য মিসেস ফ্রেজারের রান্নাঘরটি ব্যবহার করতাম। বয়সের কারণে তিনি একটি হাতল ও চাকাযুক্ত চেয়ারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হুইলচেয়ার ঠেলে রান্নাঘরে আসতেন এবং রাতে নিজের ঘরে ফিরতেন। রান্নাঘরের মাঝামাঝি একটি বৈদ্যুতিক হটপ্লেট থাকায় ঘরটি বেশ গরমই থাকত। সকালে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হুইস্কি হেলেদুলে এসে নিজের নির্ধারিত জায়গায় শুয়ে পড়ত। প্রতি রাতে ঘরে যাওয়ার আগে তিনি হুইস্কির সার্বক্ষণিক শোবার জায়গাটি পরিপাটি করে রাখতেন। হুইলচেয়ার থেকেই হুইস্কির প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের ট্রেতে রাখা বালু তিন-চারবার পরিষ্কার করতেন। তাঁর নিজের খাবার সামগ্রীর সঙ্গে হুইস্কির খাবারও বাসায় পৌঁছে যেত। মিসেস ফ্রেজার মাঝেমধ্যে হুইস্কি বলে ডাকলেই এসে ওনার কোলে বসে লেজ নেড়ে আদর নিত। 

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে সারা বছরই পোষা কুকুর-বিড়াল থাকত। প্রথম দিকে আমাদের একটি স্ত্রী বিড়াল ছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিড়ালটির দুটি বাচ্চা হলো। 

আমি সারা দিন গবেষণাগারে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে রাতে ফিরলেও দেখতাম মিসেস ফ্রেজার আমার খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। হুইস্কিও তাঁর কোলে বসে দিব্যি আয়েশ করে ঘুমাত। একদিন বেশ রাতে ফিরে খাবার সময় মিসেস ফ্রেজারের হাতের গভীর আঁচড়ের ওপর আমার চোখ পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করাতে, অপরাধী ভাব নিয়ে জানালেন, সময়মতো হুইস্কির খাবার না দেওয়ায় রাগ হয়ে সামান্য আঁচড় বসিয়েছে। আমাকে আশ্বস্ত করলেন, হুইস্কির প্রতিষেধক ইনজেকশন দেওয়া থাকায় ওনার কোনো ক্ষতি হবে না। 

আমার পড়াশোনার তৃতীয় বছরে উনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেন। এডিনবরা শহর থেকে কিছু দূরে শহরতলিতে বসবাসরত বড় ছেলে বাড়িতেই স্ত্রীর পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রমে তাঁকে রাখলেন। হুইস্কির খাওয়া আর দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। অল্প কিছুদিন পরেই মিসেস ফ্রেজার মারা গেলেন। দু-তিন সপ্তাহ পর হুইস্কিও আর বাঁচল না।

আমার ছোট ছেলে রঞ্জন ঢাকায় হাইস্কুলের পড়া শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে বৃত্তিসহ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরি নিয়ে ওখানেই থিতু হয়। অল্প বয়স থেকেই ওর বিড়াল পোষার ইচ্ছা থাকলেও হয়ে ওঠেনি। গ্র্যাজুয়েশনের পর রঞ্জন চাকরিস্থলে তিনতলা একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়। ওই অ্যাপার্টমেন্টের সাবেক ভাড়াটে অন্যত্র যাওয়ার সময় তাঁর বিড়ালটাকে পোষ্য দেওয়ার খোঁজ করছিলেন। রঞ্জনের অনেক দিনের লালিত আশাও পূর্ণ হলো। ‘গগলস’ নামের এই বিড়ালটাও নাদুসনুদুস, অলস ছিল। সারা দিন খাওয়া আর রঞ্জনের টিভির সামনের সোফায় ঘুমিয়ে কাটাত। রাতে সোফা ছেড়ে রঞ্জনের পাশেই ঘুমাত। নতুন চাকরি, বাড়িভাড়া সব মিলিয়ে রঞ্জনকে খুব হিসাব করে চলতে হতো। গ্রিনকার্ড অথবা নাগরিকত্ব ছাড়া ওই দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় রঞ্জন সহজে চিকিৎসকের কাছে যেত না। কিন্তু গগলসের সামান্য অসুস্থতাতেও ওকে নিয়ে পশুচিকিৎসকের কাছে দৌড়াত। সাত-আট বছর পর গগলসও অসুস্থ হয়ে মারা যায়। গগলসের ছবি রঞ্জন স্ত্রী ও মেয়ের ছবির পাশে সাজিয়ে রেখেছে।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে সারা বছরই পোষা কুকুর-বিড়াল থাকত। প্রথম দিকে আমাদের একটি স্ত্রী বিড়াল ছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিড়ালটির দুটি বাচ্চা হলো। বাচ্চাগুলো দেখে আমাদের মধ্যে আনন্দের ছড়াছড়ি পড়ে গেল। প্রথম দিকে দেখলাম, বাচ্চাগুলোর চোখ বন্ধ আর মা বিড়ালটা ওদের ঘাড় কামড়ে ধরে কয়েকবারই জায়গা বদল করল। বাচ্চাগুলো কয়েক দিনের মধ্যেই সারা বাড়ি ঘোরাঘুরি শুরু করল। খিদে পেলে ‘মিউ মিউ’ করে মাকে ডাকলেই মা মুখে দুধ দিয়ে ওদের গা চাটত। যখন বাচ্চাগুলো চলাফেরা শুরু করল, পাড়া থেকে বেশ কয়েকজন বাচ্চাগুলো নেওয়ার আগ্রহ দেখাল। আমার মা দুজনকে বাচ্চাগুলো দিলেন। আমার ছোট বোন বাচ্চাগুলোকে প্রায় সারাক্ষণই কোলে নিয়ে বেড়াত। তাই খুব কষ্ট পেয়েছিল।

 কিন্তু আমার মায়ের দৃঢ় সিদ্ধান্ত, আমাদের সংসারের খরচের পর ওদের খাবার জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। বছর না ঘুরতেই এবার বিড়ালটার তিনটি বাচ্চা হলো। এবারও দুটি বাচ্চার আশ্রয়ের ব্যবস্থা হলো। আম্মা তৃতীয় বাচ্চাটা একটা চটের বস্তায় ঢুকিয়ে আমার চাচাতো ভাইকে রিকশায় করে কিছু দূরের এলাকায় ছেড়ে আসতে বললেন। তার পরেরবারের দুটি বাচ্চাকে দূরে ছেড়ে আসার পরই মজার ঘটনা ঘটল। দু-তিন দিনের মধ্যে বাচ্চা দুটি একদিন দুপুরে দিব্যি ফেরত এল। আম্মা দুপুরের বিশ্রাম সেরে রান্নাঘরের দরজায় ওদের দেখে চমকে গেলেন। পরদিন খুব ভোরে উঠে বাচ্চাসহ বিড়ালটাকে বস্তায় ভরে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জে নেমে কোথাও ছেড়ে আসতে বললেন।

আমার ছোট বোনের কান্নাকাটি উপেক্ষা করেও আম্মা এই কাজ করেছিলেন। অতিরিক্ত কাজ আর খরচের পরিমাণ সামান্য হলেও মা বারবার এ রকম নিষ্ঠুর কাজ করতে চাইছিলেন না। মধ্যবিত্তের সংসারের টানাপোড়েনে মানুষ শখের পোষা প্রাণীর প্রতিও নির্দয় হতে বাধ্য হয়।