সমাজসেবা অধিদপ্তরের আরও ৭টি ‘খাতিরের’ প্রকল্প আসছে, ব্যয় ১৬০ কোটি টাকা
বিধবা ও স্বামীর হাতে নিগৃহীত নারী এবং অবহেলিত, দুস্থ ও বেকারদের জীবনমান উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিতে আরও সাতটি প্রকল্প নিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হবে ১৬০ কোটি টাকা।
যদিও এ ধরনের প্রকল্পে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে নেওয়া এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও সুফল না পাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব প্রকল্পের নাম দিয়েছেন ‘খাতিরের প্রকল্প’। কারণ ‘খাতিরের’ ভিত্তিতে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় এবং পরে ইচ্ছেমতো অনিয়ম করা হয়।
নতুন করে সাতটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য গত মাসে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। কমিশন এখন তা পর্যালোচনা করছে। এর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এ ধরনের প্রকল্পে কী সুফল পাওয়া গেছে, তার মূল্যায়ন কারও কাছে নেই।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের প্রকল্পগুলোতে কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। এই দপ্তরে আমি নতুন এসেছি। তবে নতুন করে যেসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে, সেগুলো ভালো করে দেখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশন যদি মনে করে তাহলে নতুন প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেবে।
এর আগে নেওয়া প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, এটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলতে পারবে।
প্রথম আলো তিন মাস ধরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণসংক্রান্ত পাঁচটি প্রকল্প নিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান চালায়। এ নিয়ে ১ আগস্ট ‘“খাতিরের” প্রকল্প, ইচ্ছেমতো অনিয়ম’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি প্রকল্পের আওতায় সবজি চাষের জন্য নারীদের ‘গ্রিনহাউস’ (বিশেষ ঘর) দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। আরেকটি প্রকল্পে হিজড়াদের দেওয়া প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কাজে কেউ যোগ দেয়নি। কোনো কোনো প্রকল্পে দুস্থদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও সেখানে ঢুকেছেন সচ্ছলেরা। বিধবাদের তালিকায় পাওয়া গেছে পুরুষের নাম। তালিকায় কারও কারও নাম থাকলেও তাঁরা বলছেন তাঁরা প্রশিক্ষণ পাননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতাবাবদ যে অর্থ দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি। কোথাও কোথাও কম দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, করোনার প্রেক্ষাপটে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও স্বাবলম্বী করে তোলার নামে ২১টি প্রকল্পে ৫০৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ, ৮টির কাজ চলছে। তবে শেষের পথে।
যেসব বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এসব প্রকল্প পেয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, চলচ্চিত্রের অভিনেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ এখন শুভংকরের ফাঁকি। এটি প্রতিষ্ঠিত। প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্প মূলত নেওয়া হয় এনজিওদের সুযোগ-সুবিধার জন্য। এতে সাধারণ মানুষের উপকার হয় না।
প্রকল্পগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে পরিকল্পনাসচিব সত্যজিৎ কর্মকার গত ১৭ মে নিজ দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয় এখন প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছে। কেউ তিন দিন, কেউ এক মাস, কেউ তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ খুব একটা কাজে আসছে না। সে কারণে সরকার চাইছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) মাধ্যমে সব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
অবশ্য প্রকল্প থেমে নেই। নতুন নেওয়া সাতটি প্রকল্প পেতে পারে সাতটি এনজিও। এর মধ্যে বনফুল উন্নয়ন সংস্থা ২৪ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পুওর উইমেন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ২৫ কোটি টাকা, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (এসডিএস) ২০ কোটি টাকা, মাটি ২১ কোটি টাকা, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিডাব) ২৫ কোটি টাকা, নারী উন্নয়ন ফোরাম ২৪ কোটি টাকা এবং রাইজিং এইড ফাউন্ডেশন ২১ কোটি টাকা পেতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন সভায় (পিইসি) এসব প্রকল্প নিয়ে নানা মতামত দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রকল্পের প্রশিক্ষণসংক্রান্ত অংশ বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ, প্রশিক্ষণের কাজ এখন থেকে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রক্রিয়া করবে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রশিক্ষণের প্রকল্পে প্রশিক্ষণ না থাকলে সেই প্রকল্প রাখার মানে কী।
পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়নে আরও বলা হয়, প্রকল্পগুলো সরকারের চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি (জিও-এনজিও) যৌথ উদ্যোগে প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্পগুলো অনুমোদনে একটি পক্ষ তৎপর রয়েছে। নির্বাচনের আগে তদবির করে এসব প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নিতে চায় তারা। কৌশলে প্রকল্পগুলোর ৫০ কোটি টাকার কম রাখা হয়েছে, যাতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) না ওঠাতে হয়। উল্লেখ্য, ৫০ কোটি টাকার কম ব্যয়ের প্রকল্প একনেকে ওঠাতে হয় না।
দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ এখন শুভংকরের ফাঁকি। এটি প্রতিষ্ঠিত। প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্প মূলত নেওয়া হয় এনজিওদের সুযোগ-সুবিধার জন্য। এতে সাধারণ মানুষের উপকার হয় না। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণসংক্রান্ত আগে যেসব প্রকল্প শেষ হয়েছে, সেগুলোর মূল্যায়ন না করে নতুন প্রকল্প নেওয়া সন্দেহজনক।