পুলিশ বলেছে, চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যায় অংশ নেন ২৫–৩০ জন

চট্টগ্রামে সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে গতকালও কর্মবিরতি পালন করেন আইনজীবীরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে মানববন্ধন করেন। গতকাল বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা একজন রাস্তায় পড়ে আছেন। আশপাশে ২৫–৩০ জন যুবক। একজনের পরনে কমলা রঙের গেঞ্জি, কালো প্যান্ট, মাথায় ছাই রঙের হেলমেট। পড়ে থাকা ওই ব্যক্তিকে কিরিচ দিয়ে কোপাতে থাকেন এই হেলমেটধারী। অন্য আরও তিন-চারজন তাঁকে পেটাচ্ছেন। এটি পুলিশের সংগ্রহ করা একটি ভিডিওর চিত্র।

এ ঘটনা গত মঙ্গলবার বিকেলের। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের অদূরে কোতোয়ালি থানা-সংলগ্ন সেবক কলোনির একটি বাসার সামনের রাস্তায় এভাবে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করা হয় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে। কিরিচ হাতে কোপাতে থাকা যুবকের নাম চন্দন দাস। পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিছিল শেষে ফেরার পথে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান সাইফুল। তখন তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম
ছবি : সংগৃহীত

পুলিশ বলেছে, শুধু চন্দন দাস নন, আইনজীবীকে খুনের ঘটনায় ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নেন। কোপানোয় অংশ নেন চারজন। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ ইতিমধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রামের আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত অভিযোগে গতকাল আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর হয়। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে বাধা দেন তাঁর অনুসারীরা। তাঁরা প্রিজন ভ্যান আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা করে ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

তখনই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় আইনজীবীদের গাড়ি ভাঙচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপের প্রতিবাদে মিছিল বের করেন কিছু আইনজীবী। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিছিল শেষে ফেরার পথে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান সাইফুল। তখন তাঁকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

আইনজীবী হত্যাকাণ্ডে ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ ও গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে জানা গেছে। এঁদের বেশির ভাগকেই পুলিশ শনাক্ত করেছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের  গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী
চট্টগ্রামে সংঘর্ষ ও আইনজীবী হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

৫২ সেকেন্ডের ভিডিও

ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের সংগ্রহ করা ৫২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আইনজীবী সাইফুলকে কোপান ওম দাশ, চন্দন ও রনব। তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকলেও লাঠিসোঁটা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকেন অন্যরা। সেখানে আরও ছিলেন ২৫-৩০ জন। তাঁদের মধ্যে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে রমিত দাস, সুমিত দাস, গগন দাস, নয়ন দাস, বিশাল দাস, আমান দাস, মনু মেথর ও রাজীব ভট্টাচার্যকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একজন রয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।

মঙ্গলবার থেকে সেবক কলোনির বেশির ভাগ বাসিন্দা ঘরে নেই। গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন জড়িত থাকলেও এখন সবাই বিপদে পড়েছেন। নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেই দাবি জানান তাঁরা।

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ ছিল আদালতের কার্যক্রম। আগের দিনের মতো গতকালও চট্টগ্রামের ৭৪টি আদালতে কোনো শুনানি হয়নি। সকালে জেলা আইনজীবী সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। কালো ব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানান আইনজীবীরা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী মো. হাসান প্রথম আলোকে বলেন, হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবাদে সাইফুলসহ কিছু আইনজীবী প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বান্ডিল রোডে যান। ওই সময় সশস্ত্র লোকজন তাঁদের ধাওয়া দেন। হোঁচট খেয়ে পড়ে যান সাইফুল। অন্যরা দৌড়ে প্রাণে বেঁচে যান।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী গতকাল বিকেলে নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবী হত্যাকাণ্ডে ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ ও গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে জানা গেছে। এঁদের বেশির ভাগকেই পুলিশ শনাক্ত করেছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের  গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

জড়িত আসামিদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় পাওয়া গেছে কি না এ বিষয়ে ওসি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনো পাওয়া যায়নি।

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা তিন মামলায় গতকাল আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। তাঁরা হলেন রাজীব, ববি চৌধুরী, আবদুল কাইয়ুম, কৌশিক চৌধুরী, আবির দে, রবিন দাশ ও জুয়েল দাশ। এ নিয়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৫।

আইনজীবী সাইফুল হত্যার ঘটনায় তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। তবে রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হত্যা মামলা হয়নি।

আরও পড়ুন

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। গতকাল দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেছেন, পুলিশের প্ররোচনায় সেদিন হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব কর্মকাণ্ড আদালত ভবনে সংঘটিত হয়েছে।

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে যখন কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো, তখন পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয় ছিল। কাদের ইন্ধনে চিন্ময় কৃষ্ণকে তিন ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তাঁকে হ্যান্ডমাইক দেওয়া হয়েছিল কেন। প্রিজন ভ্যান থেকে তিনি কীভাবে বক্তৃতা দিলেন। এসব বিষয়ে তদন্ত করার জন্য পুলিশ কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ তিনি বলেন, কারাগারে চিন্ময় দাসকে দেওয়া ডিভিশন প্রত্যাহার করতে হবে। নইলে কারাগার ঘেরাও করা হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারি ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। দায়িত্বে কারও গাফিলতি ছিল না।

আরও পড়ুন

আদালতের কার্যক্রম বন্ধ

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ ছিল আদালতের কার্যক্রম। আগের দিনের মতো গতকালও চট্টগ্রামের ৭৪টি আদালতে কোনো শুনানি হয়নি। সকালে জেলা আইনজীবী সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। কালো ব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানান আইনজীবীরা।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) এ এন এম হুমায়ুন কবির বলেন, চট্টগ্রাম আদালতের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কোনো মামলার শুনানি হচ্ছে না। মামলাগুলো পরবর্তী তারিখে রাখা হচ্ছে।

আইনজীবী খুনের আসামিদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি রয়েছে। দুপুর পৌনে ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত তাঁরা মানববন্ধন করেন। এ ছাড়া জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠনও আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের অদূরে আইনজীবীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই আমরা।’

আরও পড়ুন