অভ্যুত্থানে ১৩২ শিশু–কিশোর ও ১১ নারীর মৃত্যু

ছবি আঁকতে পছন্দ করত নাঈমা সুলতানা (১৫)। সেদিনও আঁকছিল। আঁকতে আঁকতেই মাকে বলছিল, সে পিৎজা বানাবে। এক ফাঁকে মাকে বলল, সে বারান্দায় যাচ্ছে শুকনা কাপড় আনতে। মেয়ের পেছন পেছন মা–ও যাচ্ছিলেন। নাঈমা বারান্দার দরজাটা খোলামাত্রই গুলিটা এসে তার মাথায় ঢুকে যায়।

এভাবেই সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মা আইনুন নাহার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের পাঁচতলা ভবনের চারতলার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয় নাঈমা।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া কিশোর শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ (১৭) গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে নিহত হয়। মা–বাবাকে সে সব সময় বলত, বড় হয়ে এমন কিছু করবে, যার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে গর্ব করবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে মোট ১৩২ শিশু–কিশোর এবং ১১ জন নারী শহীদ হয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ প্রথম আলোকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের (১৭) শূন্য আসনে ফুল রেখে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা
ছবি: শিক্ষকদের সৌজন্যে

জামিল হোসেন ও সামিরা জাহান দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মাহিন (১৬)। ৪ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে ছররা গুলিতে (শটগান) নিহত হয় সে। অভ্যুত্থানে শহীদ শিশু–কিশোরদের মধ্যে মাহিন, আহনাফদের মতো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে মোট ১৩২ শিশু–কিশোর এবং ১১ জন নারী শহীদ হয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ প্রথম আলোকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৫ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত ৮৬৫ জনের মৃত্যুর তথ্য ডেটাবেজে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮২ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তবে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্যে মৃতের সংখ্যা ৮৬০ বলা হয়েছে।

শহীদদের মধ্যে বরিশালে ১০৪ জন, চট্টগ্রামে ১২০ জন, খুলনায় ৬৮ জন, ময়মনসিংহে ৭৪ জন, রাজশাহীতে ৫৪ জন, রংপুরে ৬১ জন এবং সিলেটের ৩২ জন রয়েছেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শহীদ ১১ নারীর মধ্যে রয়েছেন মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা. আক্তার ও নাঈমা সুলতানা।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ব শিশু দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে গত ৭ অক্টোবর আয়োজিত অনুষ্ঠানে সম্মাননা ও অর্থসহায়তা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় শহীদ ১০৫ শিশু–কিশোরের পরিবারকে। তবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ৮৩ শহীদের পরিবারকে সম্মাননা ও সহায়তা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে চার শহীদ শিশুর অভিভাবক জানান, তাঁদের নাম তালিকায় নেই। এরপর অন্যান্য মাধ্যম থেকে আরও ২৩ শিশুর পরিবারকে শনাক্ত করা হয়। ফলে আরও ২৭ জন শহীদ শিশুর নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ২২ অক্টোবর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে।

মৃত অবস্থায় আনা হয় ৬৮২ জনকে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, শহীদ ৮৬৫ জনের মধ্যে ৬৮২ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১৮৩ জন। আহত ১৫ হাজার ৬৫৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে আউটডোর সেবা পেয়েছেন ১০ হাজার ১৮৬ জন। ইনডোর সেবা অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয় ৫ হাজার ৪৭৩ জনকে।

শুধু চোখে আঘাত পেয়ে চিকিৎসা নেন ৫৭১ জন। এর মধ্যে ঢাকারই ৫১২ জন।

ঢাকায় হতাহত বেশি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আট বিভাগের মধ্যে আহত ১৫ হাজার ৬৫৯ ব্যক্তির মধ্যে অর্ধেক ৭ হাজার ৩৭৮ জনই ঢাকার। এখন পর্যন্ত ডেটাবেজে সংকলিত ৮৬৫ শহীদের মধ্যে ৩৫২ জন ঢাকার। এর মধ্যে ২৬৩ জনকে মৃত অবস্থায় আনা হয় হাসপাতালে। মৃত অবস্থায় যাঁদের আনা হয়, তাঁদের মধ্যে ২২৪ জনকে সরকারি ও ৪৩ জনকে বেসরকারি হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় মারা গেছেন ৮৫ জন। এর মধ্যে ৬১ জন মারা যান সরকারি হাসপাতালে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছেন ৫৫৫ জন। এর মধ্যে ঢাকারই ৪৯০ জন।

মোট আহত ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৩ হাজার ৪২১ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ২৩৮ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

শহীদদের মধ্যে বরিশালে ১০৪ জন, চট্টগ্রামে ১২০ জন, খুলনায় ৬৮ জন, ময়মনসিংহে ৭৪ জন, রাজশাহীতে ৫৪ জন, রংপুরে ৬১ জন এবং সিলেটের ৩২ জন রয়েছেন।

বিচার চেয়েছে পরিবারগুলো

রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকার বাসার নিচে গত ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয় সাত বছর বয়সী শিশু বাসিত খান মুসা
ছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল দ্বিতীয়। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী ছিল। আইনুন নাহার জানান, সন্তানদের ভালো পড়াশোনা করাতে ওদের বাবা ওদের ঢাকার স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। অথচ ঢাকায় এসে সন্তানকে হারাতে হলো। উত্তরায় ভাড়া বাসায় তিনি তিন সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। নাঈমার বাবা গ্রামেই থাকেন।

যতবার কথা হয় নাঈমার মায়ের সঙ্গে, ততবারই তিনি মেয়ে হত্যার বিচার দাবি করেন।

একই দাবি শহীদ মায়া ইসলামের ছেলে মুস্তাফিজুর রহমানেরও। তিনিও ন্যায়বিচার চান। তিনি শুধু মাকেই হারাননি, গুরুতর আহত সন্তান মুসার ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন।

গত ১৯ জুলাই পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে মায়া ইসলাম (৬০) নাতি বাসিত খান মুসাকে (৭) আইসক্রিম কিনে দিতে নামেন। রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে মেরাদিয়া হাট এলাকায় থাকতেন তিনি। নিচে নামামাত্র গুলি এসে মুসার মাথা ভেদ করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া ইসলামের তলপেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন ২০ জুলাই তিনি মারা যান। আর নাতি মুসা গুরুতর আহত অবস্থায় এখন সরকারের সহায়তায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন।