আমরা সমাজতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ না করলেও দীর্ঘ দুই যুগের অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। পূর্ব বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি ছিল সমাজে, বৈষম্য নিয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়া ছিল। কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাবেন, শ্রমিক মানসম্মত মজুরি পাবেন—এসব দাবি মানুষের রাজনীতিবোধের কেন্দ্রে ছিল। বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণের দাবি ছিল, পাটকল,
চিনিকল আর কাগজকলগুলো রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার খাত ছিল।
মডেল হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। বহু মেধাবী তরুণের মধ্যে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাব ছিল। স্বাধীনতার পরপর ঠিক ঘরের পাশেই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, জ্যোতি বসুর ভূমিবণ্টনের সফল মডেল ছিল (২৮ লাখ ভূমিহীন কৃষক জমির মালিকানা বুঝে পেয়েছিলেন)। সময়টা সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিল। কারখানায় শ্রমিকের মালিকানা থাকবে—এমন স্বপ্ন একটা গোটা প্রজন্মকে তাড়িত করেছিল। কোনটা ‘পথ’ আর কোনটা ‘বিপথ’, তা নিয়ে সমাজে বিতর্ক জারি ছিল।
এরপর সোভিয়েত ভাঙল, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বাজার অর্থনীতির ঝান্ডা উড়ল, সত্তরের দশকে বৈষম্যের কাঠামো ভাঙতে চাওয়া রকস্টার অর্থনীতিবিদেরা ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হলেন। নব্বইয়ের দশকে সস্তা চীনা পণ্যের আগ্রাসনে পূর্ব ও পশ্চিমের বহু দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত সংকুচিত হলো। ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো ‘ফ্রি মার্কেটে’র প্রচার করল ঠিকই, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে কেউই ‘মুক্ত বাজার’ হলো না।
নিজেদের গাড়ি কারখানা, ইলেকট্রনিক শিল্প, ব্যাংক, বিমা, হাইটেক থেকে শুরু করে ছোট-বড় অজস্র শিল্পকে ভর্তুকি আর চড়া শুল্ক দিয়ে বিশ্ববাজারে টিকিয়ে রাখল পশ্চিম। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া বা চীন শিল্পায়ন করতে গোটা অর্থনৈতিক কাঠামোকেই ঢেলে সাজাল। ভারত মুক্তবাজারে ঢুকেও জওহরলাল নেহরুর ভারী শিল্পায়নের ঐতিহ্য ধরে রাখল। সুতা, গাড়ি, তাঁত অথবা পিন থেকে প্লেন—সবকিছুতে রাষ্ট্রের ভর্তুকি অব্যাহত থাকল। প্রতিকূল সময়েও ভারতের বহু অর্থনীতিবিদ কিন্তু সমাজ বদলানোর স্বপ্ন ছাড়লেন না। তাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়ার অর্থনীতিকে প্রশ্ন করে গেলেন। আর মাঝখান থেকে আমাদের অর্থনীতিবিদদের বড় অংশ এনজিওর ‘কনসালট্যান্ট’ হয়ে গেলেন।
আমাদের শিল্পায়ন হলো না। কৃষক ধান উৎপাদন করতে গিয়ে ফকির হয়ে গেলেন। আমাদের পাবনা-সিরাজগঞ্জের চার লাখ তাঁতি স্রেফ হারিয়ে গেলেন। খালিশপুর, ডেমরা আর চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেল আমাদের ২৬টি পাটকল! বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের নিখুঁত বিকল্প।
আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ৪০ বছর ধরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করে আসছে। অথচ আমরা বাপেক্সের দক্ষ প্রকৌশলীদের বসিয়ে রেখে দেশের মহামূল্যবান গ্যাসকূপগুলো তুলে দিলাম বিদেশি কোম্পানির হাতে, দ্বিগুণ খরচে। আমরা শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ আর ঠাকুরগাঁওয়ের চিনিকলগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দিলাম। আমাদের চাষিরা আখ চাষ ছেড়ে দিলেন। আমরা এখন ডলার খরচ করে বিদেশি চিনি খাই।
আমাদের অর্থনীতিবিদেরা গার্মেন্টস আর রেমিট্যান্স নিয়ে মেতে রইলেন। বললেন না, এটা তো সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের অর্থনীতি! এখানে প্রত্যেক শ্রমিক ঋণগ্রস্ত কেন? দুদক মামলা করে দেখাল, আসলেও তা–ই। গার্মেন্টস মালিকদের হাত থেকে প্রতিবছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। তার মানে এখানে মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ হয় না। মুনাফা পাচার হয়। অথচ আমাদের শ্রমিক আজীবন সেলাই মেশিন চালিয়েও দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারল না। তারপর তো চলে এল মেশিন। শ্রমিক ছাঁটাই হতে লাগল, হাজার হাজার। অথচ ম্যাকেঞ্জি রিপোর্ট সাবধান করে দিয়েছিল, অটোমেশন বাড়বেই। শ্রমিকবিহীন মুনাফার মডেল হতে যাচ্ছে গার্মেন্টস।
এরপর ছাঁটাই হওয়া হাজারো শ্রমিক ধারদেনা করে ইজিবাইক কিনলেন। চীনা পণ্যের অনুকরণে দেশি মেকানিকদের মেধা, পরিশ্রম আর সৃজনশীলতায় মাত্র এক দশকের মাথায় তৈরি হলো ৪০ লাখ মানুষের এক শক্তিশালী থ্রি–ইউলার শিল্প। আর আমরা কী করলাম? প্রথমে ‘জবলেস গ্রোথ’ করলাম, তারপর আইন করে বেকার তরুণদের ইজিবাইক চালানো নিষিদ্ধ করলাম। এখানে বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচে পায়রা বন্দর আর মাওয়া রুট তৈরি হলো, কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখা ঠেলা, ভ্যান ও অটোরিকশার জন্য সার্ভিস রোড তৈরি হলো না।
এরপর শুরু হলো ব্যাংক লুট। ইন্দোনেশিয়ায় জেনারেল সুহার্তো তিন দশকের চুরি করেছিলেন ৩৫ বিলিয়ন ডলার। তবু সে লুটপাটের টাকা দেশেই বিনিয়োগ হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল অজস্র কর্মসংস্থান। আর আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের দাবদাহে কামাই করা শ্রমিকের ডলার লুটপাট করে বেগম পাড়ায় পাচার করে দেওয়া হয়। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কেনায় আমরা দ্বিতীয় হই। বিশ্বে ধনী বৃদ্ধির হারে প্রথম হই। অথচ ধনীদের বিপুল ধন দেশে থাকে না। বিদেশে পাচার হয়ে যায়।
আমরা পুঁজিবাদও ঠিকমতো করতে পারলাম না। কায়েম করলাম চুরিবাদ। আমরা ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ কায়েম করতে গিয়ে জনগণের ভোটের অধিকারও হাপিশ করে দিলাম। আমরা সম্পদ ও আদর্শ দুই-ই হারালাম।
আর এই সবকিছুর বদলে আমরা পেলাম বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচে তৈরি হওয়া ‘উন্নয়ন’ নামের কিছু অদ্ভুত জঞ্জাল।
মাহা মির্জা: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক।