‘ডিজিটাল জ্ঞানের অভাবে’ স্মার্টফোন ও মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে বাংলাদেশ
মীনার মুঠোফোনে কল এলে যে শব্দ হয় সেটা মাঝেমধ্যে কমে যায়। কিন্তু সে শব্দ কীভাবে আবার বাড়িয়ে নিতে হবে, তা তাঁর জানা নেই। তিনি শুধু কল দিতে পারেন, কল এলে ধরতে পারেন। মুঠোফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন, অনলাইন মাধ্যমে আরও যেসব সুবিধা বা বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে জানেন না তিনি। এসবের জন্য স্মার্টফোন প্রয়োজন। কিন্তু মীনার ভাষ্য, ‘বাটন মোবাইলই (ফিচার ফোন) ঠিকমতো চালাইতে পারি না। বড় ফোনের (স্মার্টফোন) তো কিছুই বুঝব না।’
ভ্যানে করে ফল বিক্রি করেন মো. ইলিয়াস। পাঁচজনের সংসারে স্মার্টফোন আছে তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলের। করোনা মহামারির সময় অনলাইনে ক্লাস করার জন্য জমানো টাকায় ছেলেকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেন তিনি। ইলিয়াসও ‘ভালো নেটওয়ার্ক’ সুবিধার আওতাভুক্ত এলাকা রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। স্মার্টফোন ব্যবহার না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একটা মোবাইল কিনতে ৮–১০ হাজার টাকা লাগে। বাজারে সবকিছুর যে দাম! আর ওই ফোন আমার লাগেও না।’
রাজধানীর বাসিন্দা গৃহকর্মী মীনা ও মো. ইলিয়াসের মতো দেশের যেসব মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের অর্ধেকের বেশির স্মার্টফোন নেই। তাঁদের মধ্যে অনেকে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গত জুলাই মাস পর্যন্ত হিসাবে, দেশে মুঠোফোনের সিম ব্যবহার হচ্ছে ১৮ কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে মুঠোফোন ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে ১১ কোটি ৬৪ লাখ সংযোগে। কেউ ৯০ দিনে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তাঁকে ইন্টারনেট গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করে বিটিআরসি।
মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএ–এর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে যাঁরা মুঠোফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ৪১ শতাংশ। এ ছাড়া সংগঠনটির ২০২২ সালের মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদনে দেশের নারী ও পুরুষ গ্রাহকদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ব্যবধানের বিষয়টি উঠে আসে। সেই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ পুরুষ এবং ২১ শতাংশ নারী।
স্মার্টফোন ব্যবহারে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশে পিছিয়ে আছে। তবে প্রতিবেশী এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে একটি মুঠোফোন কিনতে বেশি কর দিতে হয়। এতে সাধারণ মানুষের স্মার্টফোন কেনার হারও কমছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে ব্যবসায়িক পর্যায়ে মুঠোফোনের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে সরকার। সেই ভ্যাট ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। এই ভ্যাট আরোপের পর দেশে স্মার্টফোন বিক্রি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কমেছে।
২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ও কার্যকর নীতি প্রণয়নে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল বিভাজন (ডিজিটাল ডিভাইড) কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে ব্রডব্যান্ড কমিশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি স্মার্টফোনের সর্বজনীন ব্যবহার নিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর ‘স্ট্র্যাটেজিস টুয়ার্ডস ইউনিভার্সাল স্মার্টফোন অ্যাকসেস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না ১৫টি দেশের এমন মানুষদের নিয়ে ২০১৯–২০ সালে একটি গবেষণা করে জিএসএমএ। ব্রন্ডব্যান্ড কমিশন ওই গবেষণার বরাত দিয়ে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনই মনে করেন না, সামর্থ্য না থাকায় ব্যবহার করেন না ১১ শতাংশ, সুযোগ না থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না এমন মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তাজনিত কারণে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না।
ব্রডব্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ ৩–জি নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় এসেছেন। উন্নত দেশগুলোতে এটা ৯৯ শতাংশ হলেও নিম্ন আয়ের দেশে এই হার ৮৬ শতাংশ। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের এক–তৃতীয়াংশ মানুষ (২৭০ কোটি) এখনো ইন্টারনেটে যুক্ত নন। এর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ ভালো ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় বাস করেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে যেসব মানুষের উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে, তাঁরা এখনো ২–জি ও ৩–জি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এতে তাঁরা উচ্চগতির ইন্টারনেট–সংযোগ ব্যবহারের সামাজিক ও আর্থিক সুবিধার বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষেরই ইন্টারনেট সুবিধা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তাঁরা তা নিচ্ছেন না, যা ডিজিটাল বিভাজনকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাধা কোথায়, সে বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করার পাশাপাশি সেটা কীভাবে কমানো যায়, তা ভাবতে হবে নীতিনির্ধারকদের।
মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে একজন ব্যক্তির আর্থসামাজিক উন্নতি নিয়ে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ও ঘানায় পরিচালিত একটি জরিপের বরাত দিয়ে ব্রন্ডব্যান্ড কমিশন বলেছে, মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় এই দুই দেশের মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর্থসামাজিক অবস্থান আগের চেয়ে অন্তত ৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই আর্থসামাজিক অবস্থানের উন্নতির হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন এমন ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ।
জিএসএমএ–এর তথ্যের বরাতে ব্রডব্যান্ড কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৯৪ শতাংশ মানুষের মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ৫১ শতাংশ মানুষ তা ব্যবহার করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে গড়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে, কিন্তু ব্যবহার করেন ৩৪ শতাংশ। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে পিছিয়ে আছে শুধু সাব–সাহারা আফ্রিকার দেশগুলো।
এদিকে জাতিসংঘের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) হিসাবে বিশ্বে গড়ে ৮৫ শতাংশ মানুষ ৪–জি নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় এসেছেন। কিন্তু ৪–জি ব্যবহার করেন ৫৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে পিছিয়ে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের দেশগুলোর ৭৮ শতাংশ মানুষ ৪–জি নেটওয়ার্ক সুবিধার আওতায় এসেছেন। কিন্তু ৪–জি ব্যবহার করেন ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ সুযোগ থাকলেও অনেকেই ৪–জি ব্যবহার করছেন না।
উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ নিয়ে জিএসএমএ–এর ১৬০টি দেশকে নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইন্টারনেটের গতি ২–জি থেকে ৩–জিতে উন্নীত হলে একটি দেশের জিডিপি বাড়ে ১৫ শতাংশ এবং ২–জি থেকে ৪–জি উন্নীত হলে জিডিপি ২৫ শতাংশ বাড়ে।
মোবাইল ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে দেশে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব)–এর মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এস এম ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, উভয় ক্ষেত্রেই জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। স্মার্টফোন কিনতে না পারা বা ব্যবহারের দক্ষতা না থাকাটা যেমন মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার না করার অন্যতম কারণ তেমনি এই ইন্টারনেট কী কাজে আসবে, সেটা বুঝতে না পারাও একটা বড় কারণ।
এস এম ফরহাদ বলেন, এর জন্য জ্ঞানের অভাব ও মানুষের আর্থিক অবস্থাও দায়ী। এ ছাড়া আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে এবং শিক্ষিত—এমন অনেকে আছেন, যাঁরা বয়সের কারণে বা নিরাপত্তার কারণে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। তাই ফোর–জির আওতায় থেকেও শুধু সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অনেকে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এ জন্য মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুফল সম্পর্কে সচেতনতার ওপর জোর দেন তিনি।