সেমিনারে বক্তারা: উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভূমি দখল হচ্ছে
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে তাঁদের ভূমি দখল করা হচ্ছে। তাঁরা বলেছেন, বনের বেদখল জায়গা উদ্ধারের নামেও তাঁদের ভূমি দখল চলছে।
‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২২’ উপলক্ষে এক সেমিনারে আঞ্চলিক পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন মধুপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতা অজয় মৃ এবং গাইবান্ধার বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে। আজ সোমবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ঐতিহ্যগত জ্ঞান, ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে আদিবাসী নারীর ভূমিকা: চ্যালেঞ্জ ও আমাদের দায়িত্ব’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে ১৫টি সংগঠন। সেগুলো হলো—এএলআরডি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন, মালেয়া ফাউন্ডেশন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, সিসিডিবি, কারিতাস–বাংলাদেশ, ব্লাস্ট, বেলা, নিজেরা করি, আরবান, সিডিএ, টিআইবি, এইচডিআরসি, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
অজয় মৃ বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের নামে তাঁদের ভূমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। মধুপুর ন্যাশনাল পার্কের নামে তাঁদেরকে উচ্ছেদের নোটিশ করা হয়। এখন প্রকল্পের আওতায় খাল খননের নামে মধুপুরে তাঁদের ভূমি দখলের চেষ্টা চলছে। বনের বেদখল ভূমি উদ্ধারের নামে তাঁদের জায়গা দখল করা হয়। সামাজিক বনায়নের নামে মধুপুরের প্রাকৃতিক বন নষ্ট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘প্রকল্পের নামে বিভিন্নভাবে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে বিভক্তি, বিভ্রান্ত করে বাপ-দাদার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে আমাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।’
পাহাড়ের তুলনায় সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের অবস্থা বেশি খারাপ বলে মনে করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেনন বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য তাদেরকে এক হতে হবে। পাশাপাশি তাদের অধিকারের আন্দোলনে বাঙালিদেরও অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) চেয়ারপারসন ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির। তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সবাইকে দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য চর্চা করতে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই একমত।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সমতলে যারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের ভূমি দখল করে, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটাই হচ্ছে দখল করা। তিনি বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আমরা পড়ে গেছি। বিচার না হওয়ার সিস্টেমে সংস্কার আনতে হবে। দলীয় আনুগত্যের মধ্যে থেকে সংস্কারের কথা বললে তা হবে না। ইস্যুভিত্তিক সংস্কারের দাবি করতে হবে।’
আগামী বৃহস্পতিবার একটি মামলার শুনানি আছে, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ মুছে ফেলতে বলা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অনারারি নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেই শুনানিতে আপনারা আসেন। সেখান ‘আদিবাসী’ শব্দ মুছে ফেলার বিষয়ে কী যুক্তি আসে, তা শোনেন। সেখানে যদি আপনাদের মতবিরোধ থাকে, তা সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারবেন।’
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব ব্যবসায়ী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভূমি দখল করছেন, তাঁরা তো সামনের সারির। ব্যবসায়ীদের পেছনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সর্বগ্রাসী। তাঁরা প্রকৃতি ও রাজনীতির সর্বনাশ করছেন।
বর্তমান সরকার অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, একসময়ের নির্যাতিত বাঙালিরাই এখন নিপীড়ক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রকৃতি, বন, পাহাড় ধ্বংস করি না। আমরা মনে করি, ভূমি আমার নয়, আমরা তার।’
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা ও পুয়ামদোর নির্বাহী পরিচালক হৈমন্তি সরকার। স্বাগত বক্তব্য দেন এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান।