টিকে থাকার লড়াইয়ে স্টার্টআপ
পণ্য সরবরাহ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পেপারফ্লাইয়ের ব্যবসা একসময় খুব ভালো চলছিল, বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়ে। তবে তহবিল সংকটের কথা জানিয়ে গত অক্টোবরে কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
পেপারফ্লাই হচ্ছে একটি স্টার্টআপ, অর্থাৎ উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য বলছে, গত নভেম্বর থেকে তারা সীমিত পরিসরে আবার কাজ শুরু করেছে।
শুধু পেপারফ্লাই নয়, দেশের আরও অনেক স্টার্টআপকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে কোনোটি দীর্ঘ সময় কার্যক্রম বন্ধ রেখে আবার ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে, কোনোটি ফিরতেই পারেনি।
করোনাকালে মানুষের চলাচল ছিল কম। তাই এ সময় পণ্য সরবরাহসহ এ ধরনের সেবার চাহিদা বাড়ে। এতে স্টার্টআপের বাজারও সম্প্রসারিত হতে থাকে। কিন্তু মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পর করোনাকালীন সেই চাহিদা সেভাবে আর থাকেনি। ফলে করোনার পর নানামুখী সংকটে পড়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার করোনা মহামারির সময় কিছু স্টার্টআপ বন্ধও হয়ে যায়। তারা আর ব্যবসায় ফিরতে পারেনি।
তিনজন স্টার্টআপ উদ্যোক্তা এবং এ খাত জানেন-বোঝেন, এমন দুজন প্রথম আলোকে বলেছেন, স্টার্টআপগুলোর বিপত্তির বড় কারণ বিনিয়োগ সংকট। বিশ্বজুড়ে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কমছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশেও। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ব্যবসায়িক মডেলের অভাব, বাজার না বোঝা, তহবিল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার মতো আরও কিছু সমস্যা আছে এ খাতে।
দেশের স্টার্টআপ খাতে ৬১ শতাংশের ওপরে বিনিয়োগ এসেছে ফিনটেকে (প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেন ও আর্থিক সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান)। এরপর আছে সরঞ্জাম, ব্যবস্থাপনা ও যাতায়াত (লজিস্টিক ও মোবিলিটি), ই-কমার্স ও রিটেইল, স্বাস্থ্য খাত, সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি এবং ভ্রমণ।
মহামারির প্রভাব
বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে স্টার্টআপের ধারণা পরিচিতি পেতে শুরু করে। করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সাল থেকে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ দ্রুত বেড়ে যায়, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ। পাশাপাশি দেশীয় কিছু উদ্যোগও এগিয়ে আসে। এতে স্টার্টআপের বাজার সম্প্রসারিত হতে শুরু করে।
করোনার সময় মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটাই চার দেয়ালে আটকে যায়। তাই ঘরে বসে সেবা পাওয়ার প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন স্টার্টআপ বাজারে আসে এবং সফলও হয়। এ ছাড়া পুরোনোদেরও অনেকে এ সময়ে বেশ এগিয়ে যায়। কিন্তু মহামারির পর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতেই এসব স্টার্টআপের সেবার চাহিদা কমে। পাশাপাশি শুরু হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক নানা সংকট।
করোনার সময়ে চালু হওয়া পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ রেডএক্স অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দুই বছরের মাথায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না আসায় প্রতিষ্ঠানটি কিছু সেবা কমিয়ে এনেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কর্মীও ছাঁটাই করেছে রেডএক্স।
অন্যদিকে ক্যাম্পাসভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল জোবাইক। করোনার আগে যাত্রা করেই দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা এবং পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে সেবা দেওয়া শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু মহামারি শুরুর পর জোবাইককে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই ব্যর্থতার জন্য বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কিছু নীতিকেও দায়ী করছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মীদের অনেকে। তাঁরা জানান, অনেক কর্মীর বকেয়া বেতনের অর্থ এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
জোবাইকের প্রধান নির্বাহী মেহেদী রেজা প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময়ে মানুষের চলাচল কমে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ হয়ে যায় এ সময়। ফলে তাদের কার্যক্রমও স্থগিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সাইকেলগুলো নষ্ট হতে থাকে। তবে ঈদের পর আবার কার্যক্রম শুরু করতে চান বলে জানালেন তিনি।
ই-কমার্সের বাজার এখনো তত বড় হয়নি। কিন্তু করোনার সময়ে হঠাৎ বাজার বেড়ে যায়। ফলে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। করোনার প্রভাব চলে যাওয়ার পর মানুষ আবার প্রচলিত জীবনধারায় ফিরে যায়। ফলে করোনার সময়কে ধরে যেসব ব্যবসা শুরু হয়েছিল, তারা এখন বাজারের আসল চরিত্রটা বুঝতে পারছে।ফাহিম মাশরুর, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা
বিনিয়োগ কমছেই
দেশের স্টার্টআপ খাত নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স। তাদের তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন সক্রিয় স্টার্টআপ আছে আড়াই হাজার। এ খাতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ কাজ করেন।
গত এক যুগের বেশি সময়ে দেশের স্টার্টআপ খাত মোট বিনিয়োগ পেয়েছে ৯৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ৮৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারই বিদেশি বিনিয়োগ। আর মোট বিনিয়োগের ৬৬ শতাংশ হয়েছে গত চার বছরে, অর্থাৎ মহামারি ও তার পরের সময়ে।
লাইটক্যাসলের করা ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৩’ অনুযায়ী গত বছর দেশে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪২ শতাংশ কম। ২০২২ সালে বিনিয়োগ ছিল প্রায় ১১ কোটি ও ২০২১ সালে সাড়ে ৪১ কোটি, যা ছিল এক বছরে সর্বোচ্চ। এ খাতে স্থানীয় বিনিয়োগ বরাবরই কম। গত বছরের মোট বিনিয়োগের ৬৩ শতাংশই এসেছে বিদেশ থেকে।
সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থা স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড এখন পর্যন্ত ৩০টি স্টার্টআপে সাড়ে ৭৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আরেক সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) ‘আইডিয়া’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৮৫টি স্টার্টআপকে দিয়েছে ২৬ লাখ ডলারের কিছু কম।
স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অন্য দেশে বড় করপোরেট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে এর অভাব রয়েছে। তবে কোনো স্টার্টআপ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলে সেই প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য দেখে সহায়তা করা হয় বলে জানান তিনি।
তবে স্টার্টআপ খাত পর্যবেক্ষণ করেন এমন একাধিক ব্যক্তি বলছেন, বিনিয়োগ নিয়ে যে সহায়ক ব্যবস্থা থাকা দরকার, দেশে তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া এখনকার উদ্যোক্তারা তরুণ ও অনেক বেশি ঝুঁকি নেন। বিনিয়োগ পেলেই তাঁরা টেকসই মডেলের চেয়ে বাজার বাড়ানো ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধিতে বেশি মনোযোগ দেন। কিন্তু বিনিয়োগে সুবিধা করতে না পারলে এবং মুনাফার পথ তৈরি না হলে কর্মী ছাঁটাই শুরু করে।
অন্য দেশে বড় করপোরেট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে এর অভাব রয়েছে।সামি আহমেদ, স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
বাজার ধরতে না পারা
দেশের প্রথম খাদ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ছিল হাংরিনাকি। কিন্তু বাজারে প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে হাংরিনাকি কিনে নিয়েছিল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দারাজ। এ সময় হাংরিনাকির সেবা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল তারা। অথচ এখন এর অস্তিত্ব নেই।
পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞ দুজন বলছেন, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত গ্রাহকদের যারা ধরতে পেরেছে, বাংলাদেশে সেসব স্টার্টআপই ভালো অবস্থানে আছে। যেমন বিকাশ, যাদের সেবা নিম্নবিত্তদের জন্যও উপযোগী। আবার শপআপের মতো প্রতিষ্ঠান, যাদের ব্যবসার মডেল মুদিদোকানভিত্তিক, তারাও নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের ধরতে পেরেছে।
স্টার্টআপ বাংলাদেশের সামি আহমেদ বলেন, স্টার্টআপ নিয়ে যেসব ‘আইডিয়া’ আসে, তার বেশির ভাগই ই-কমার্স ও খুচরা বিপণনভিত্তিক। ডিপ টেকনোলজি (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োপ্রযুক্তি, রোবোটিকস, ড্রোন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ইত্যাদি) নিয়ে আইডিয়া আসছে কম।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ই-কমার্সের বাজার এখনো তত বড় হয়নি। কিন্তু করোনার সময়ে হঠাৎ বাজার বেড়ে যায়। ফলে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। করোনার প্রভাব চলে যাওয়ার পর মানুষ আবার প্রচলিত জীবনধারায় ফিরে যায়। ফলে করোনার সময়কে ধরে যেসব ব্যবসা শুরু হয়েছিল, তারা এখন বাজারের আসল চরিত্রটা বুঝতে পারছে।