বেপরোয়া বালু তুলে যমুনার সর্বনাশ
অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় কাওয়াকোলা ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক নদীতে বিলীন। নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ পরিবার।
মাঝনদীতে নৌকার মাঝি স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বুঝেশুনে বলতে বললেন। পরে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বড় কয়রা ঘাটে নেমে চরের তিন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় মাঝির সতর্কতা মেনে। বয়োজ্যেষ্ঠ এক বাসিন্দা বলেন, ‘বালু নিয়ে খুন-খারাপি হয়েছে, আমরা কিছু কইলেই তুইল্যা ওপারে নিয়া সাইজ করবো (মারবে)।’
নদী থেকে বালু তোলার প্রসঙ্গ উঠলেই কাওয়াকোলার চরবাসীর চোখে-মুখে এমন আতঙ্কের ছাপ। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলার কারণে ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক নদীতে বিলীন হয়েছে। তিন মাস আগেও নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ পরিবার।
গত ২২ অক্টোবর সকালে সিরাজগঞ্জ শহরের জেলখানা ঘাট থেকে নৌকাযোগে কাওয়াকোলা যেতে দেখা গেল, যমুনা নদীতে অর্ধশত ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে নদীর হার্ড পয়েন্ট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারে ছোটাছুটি করছে শতাধিক বাল্কহেড। কোনোটা বালু নিয়ে যাচ্ছে, কোনোটা নিতে আসছে। নৌকার মাঝি বলেন, সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী এখন বালুর বড় ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে গেছে।
বালুমহাল ইজারার শর্ত, ইজারা নেওয়া এলাকার বাইরে বালু উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ছাত্তারের লোকজন নিয়মনীতি মানছেন না।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট হয়ে যমুনা সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করেছে কাজীপুর উপজেলা দিয়ে। সিরাজগঞ্জে যমুনার দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার। বালু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, জেলায় এ নদীতে বেপরোয়া বালু উত্তোলন ও বাণিজ্যের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ করেন পৌর আওয়ামী লীগের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি আবদুস ছাত্তার। তাঁর সঙ্গে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। বালু তোলাকে ঘিরে ছাত্তারের মতো সরকারদলীয় নেতাদের একাধিক চক্র তৈরি হয়েছে। তাঁরা প্রতিবছর বালুমহালের ইজারা পাচ্ছেন এবং নিয়মনীতি ভেঙে বালু তুলছেন।
২৪ অক্টোবর সকালে পুরাতন জেলখানা ঘাট, শেখ রাসেল শিশুপার্ক ও মতিন সাহেবের ঘাট এলাকায় দেখা যায়, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ১০০ মিটার দূরত্বে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে কয়েক শ কোটি টাকার শহর রক্ষা বাঁধ হুমকিতে পড়েছে।
নিয়ম মানছেন না ইজারাদার
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জে যমুনায় সরকারিভাবে পাঁচটি বালুমহাল রয়েছে। সদর উপজেলায় চারটি ও কাজীপুরে একটি। এ বছর সদর উপজেলার কৈগাড়ী দোরতা ও শিমলা বালুমহাল দুটির ইজারা নেন আবদুস ছাত্তার। তাঁর সঙ্গে ৩০-৩৫ জন অংশীদার রয়েছেন।
বালুমহাল ইজারার শর্ত, ইজারা নেওয়া এলাকার বাইরে বালু উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ছাত্তারের লোকজন নিয়মনীতি মানছেন না।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় তাঁরা (ইজারাদার) সীমানার বাইরে চলে যান। তারা (প্রশাসন) জানতে পারলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে।
২৪ অক্টোবর সকালে পুরাতন জেলখানা ঘাট, শেখ রাসেল শিশুপার্ক ও মতিন সাহেবের ঘাট এলাকায় দেখা যায়, সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের ১০০ মিটার দূরত্বে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে কয়েক শ কোটি টাকার শহর রক্ষা বাঁধ হুমকিতে পড়েছে।
নিয়মনীতি না মেনে বালু তোলার অভিযোগ প্রসঙ্গে এস কন্সট্রাকশন নামের প্রতিষ্ঠানের মালিক আবদুস ছাত্তার বলেন, তাঁরা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে ব্যবসা করেন। ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষরা তাঁদের হয়রানি করতে নানা অভিযোগ তুলছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় থাকা ৪ নম্বর ক্রসবার এলাকায় গেলে কয়েকজন জেলে জানান, নদীর বিভিন্ন স্থানে রাতেও বালু তোলা হয়। এ নিয়ে জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বালু নিয়ে তাঁরা অস্বস্তিতে আছেন। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি সভায় তিনি রাতে যেখানে-সেখানে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে বলেছেন।
ছাত্তারের ইজারা নেওয়া বালুমহালের নামে প্রতিদিন ছোট-বড় ৩০-৩৫টি ড্রেজার বসিয়ে বালু ওঠানো হয়। প্রতিদিন গড়ে ১০০ বাল্কহেডে করে বালু নিয়ে যাওয়া হয় সাভার, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জে।
ছাত্তারদের বছরে ব্যবসা ২৫০ কোটি টাকা
ড্রেজার ও বাল্কহেডের কয়েকজন চালক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ছাত্তারের ইজারা নেওয়া বালুমহালের নামে প্রতিদিন ছোট-বড় ৩০-৩৫টি ড্রেজার বসিয়ে বালু ওঠানো হয়। প্রতিদিন গড়ে ১০০ বাল্কহেডে করে বালু নিয়ে যাওয়া হয় সাভার, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জে।
জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার হিসাবে সরকার এ বছর চারটি বালুমহাল মিলে রাজস্ব পেয়েছে ২৬ কোটি টাকা। আর স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীদের দাবি, শুধু আবদুস ছাত্তারই দুই বালুমহালের নামে বছরে অন্তত ২৫০ কোটি টাকার বালু তোলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় কোনো বালুমহাল নেই। কিন্তু এসব উপজেলার অন্তত ২০টি স্থান থেকে অননুমোদিত বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে।
অন্য উপজেলার চিত্রও একই রকম
কাজীপুরের ১৯৪ একরের বালুমহালটির ইজারা নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কাজীপুর ইউপির চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বিপ্লব। বালু ব্যবসায় তাঁর সঙ্গে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বর্তমান এবং সাবেক কয়েকজন নেতা।
স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, কাজীপুর মৌজায় বালুমহালের অবস্থান হলেও তিন কিলোমিটার উজানে মেঘাই মৌজা থেকে বালু তোলা হয়। এতে গত ৭ জুলাই মেঘাই স্পার বাঁধের ৩০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ১২ জুলাই যমুনার তীর সংরক্ষণ বাঁধের ১৫০ মিটার অংশের ব্লক বিলীন হয়েছে।
ইজারাদার কামরুজ্জামান বিপ্লবের দাবি, ভাঙনের জায়গা থেকে বালু তোলা হয়নি। অনেকে মনগড়া অভিযোগ করছেন। কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুখময় সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙনকবলিত স্থান থেকে বালু তোলা বন্ধ করা হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত স্থানীয় একজন শিক্ষক বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে এখনো অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় কোনো বালুমহাল নেই। কিন্তু এসব উপজেলার অন্তত ২০টি স্থান থেকে অননুমোদিত বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় সরকারদলীয় নেতারা।
শাস্তির আওতায় আনতে হবে
জেলার বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে নৌ পুলিশের তেমন তৎপরতা নেই। তবে সদর নৌ থানার জ্যেষ্ঠ উপপরিদর্শক জহরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা নিয়মিত অভিযান চালান।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদীর নাব্যতা রক্ষায় এবং ভরাট রোধে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে বালু তুলতে হবে। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালীরা বালুমহাল ইজারা নিয়ে বেপরোয়াভাবে বালু তুলে নদীর সর্বনাশ করছেন। অবৈধভাবে বালু তোলা ফৌজদারি অপরাধ। তাই শুধু জরিমানা নয়, জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে।