যে শিশুর বয়স দুই বছর ছিল, তখন তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এখন হয়তো তার মনেও নেই, তার বাবা দেখতে কেমন ছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর তার এখনো জানা নেই যে তার বাবা কোথায়, তার বাবা কি আদৌও বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকের পেট কেটে ফেলা হয়েছে, নাড়িভুঁড়ি বের করা হয়েছে, বস্তা দিয়ে বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, রাতের অন্ধকারে ক্রসফায়ারে জীবন গেছে কত মানুষের!
আজ বুধবার ‘গণহত্যা, গুম ও ভয়ের সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুমের ঘটনা ও এর পরিণতি নিয়ে এ কথাগুলো উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী অডিটরিয়ামে ‘সপ্রাণ’ আয়োজিত এই আলোচনা সভায় গণহত্যা ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুবিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান বক্তারা।
সভায় কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার নিজে গুম হওয়ার সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এটা একটা অবিশ্বাস্য রকমের ট্রমা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের এই ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। তাঁদের পরিবারগুলো সেই কষ্ট দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়ায়। যাঁরা গুম হয়েছেন, তাঁরা যেন সুবিচার পান, সেই দাবি জানান তিনি।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান লিটন। আলোচনায় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে কোনো রাজনৈতিক দল বলা যাবে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এরা এমন কিছু নেই, যা করেনি। গণহত্যা, গুম, ক্রসফায়ারসহ ভিন্নমত দমনে সবকিছুই করেছে দলটি।
নূর খান লিটন বলেন, তাঁদের (গুমের শিকার ব্যক্তি) আয়নাঘরে এমন ভয়ংকর বন্দী হিসেবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে, যেখানে পাঁচ–ছয় ফুট একটা জায়গায় সাপের মতো প্যাঁচ দিয়ে একটা মানুষকে থাকতে হয়। তিনি বলেন, গুমের শিকার অনেক ব্যক্তির পেট কেটে ফেলা হয়েছে, নাড়িভুঁড়ি বের করা হয়েছে, বস্তা দিয়ে বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, রাতের অন্ধকারে ক্রসফায়ারে তাঁদের জীবন দিতে হয়েছে।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘আমরা যখন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলি, গুমের শিকার যাঁরা পরবর্তীকালে ফিরে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে যখন কথা বলি, তাঁরা যে কী ভয়ংকর ট্রমার মধ্য দিয়ে যান, তাঁদের কথাগুলো শুনে আমরা বুঝতে পারি।’ তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এই ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে গত ১৫ বছর পুরো দেশ চুপ ছিল। যে পরিবারের মানুষেরা এখনো গুমের শিকার ব্যক্তিদের পাননি, সেই সব পরিবারই বা ভবিষ্যতে কীভাবে জীবন পার করবে?
নৃবিজ্ঞান ও গুমবিষয়ক গবেষক ইয়াসমিন আরা বলেন, যে শিশুর বয়স দুই বছর ছিল, তখন তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এখন হয়তো তার মনেও নেই, তার বাবা দেখতে কেমন ছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর তার এখনো জানা নেই যে তার বাবা কোথায়, তার বাবা কি আদৌও বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন।
সভায় জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ফারহান ফাইয়াজের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ফাইয়াজ হত্যার বিচার দাবি করেন।