শ্বশুরবাড়ি গেলে উবারচালক বউকে দেখতে আসেন প্রতিবেশীরা
মারিয়াম আক্তার এক বছর ধরে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং উবারের নিবন্ধিত চালক। মাসে অন্তত ২০ দিন গাড়ি (প্রাইভেট কার) নিয়ে বের হন তিনি। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অনার্সে পড়ছেন তিনি। জানালেন, যেদিন গাড়ি নিয়ে বের হন, সেদিন গাড়ির তেল, উবারের কমিশন বাদ দিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন।
মারিয়াম বললেন, পুরুষ চালকেরা গাড়ি চালানোর ফাঁকে চা, সিগারেট, পান খান, আড্ডা দেন। এতে তাঁদের বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হয়। তিনি প্রায় সময় বাসা থেকে খাবার নিয়ে বের হন।
পান-চা খান না, আড্ডাও দেন না। নিজের গাড়ি হওয়ায় নিজের মতো সময় ঠিক করে নেন। কাজ শেষে ফিরতে মাঝেমধ্যে রাত ১০টা ১১টা বেজে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন ক্লাস থাকে না। যেদিন থাকে, কাজের ফাঁকেই ক্লাস সেরে নেন। শিক্ষকেরা জানেন তিনি উবার চালিয়ে সংসার চালান, তাই এ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না।
নিজের পছন্দ ও পরে পারিবারিকভাবেই মারিয়ামের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তিনি ও তাঁর স্বামী নাসির উদ্দিন শিক্ষার্থী ছিলেন, এখনো পড়াশোনা করছেন। তখন মারিয়ামের বয়স ছিল ১৮ বছরের একটু বেশি। সাড়ে তিন বছর বয়সী এক ছেলে আছে এ দম্পতির। করোনার আগে তাঁরা পড়াশোনার পাশাপাশি যা আয় করতেন, তা দিয়ে ভালোভাবেই চলতেন। তবে করোনা তাঁদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছিল।
জুতা বানাতেন মারিয়াম
ইউটিউবে দেখে মেয়েদের জুতা বানানো শিখেছিলেন মারিয়াম। পরে ছোট একটি কারখানা চালু করেছিলেন, নয়জন কর্মী কাজ করতেন। নিজেও জুতা বানাতেন। তাঁর স্বামী বাসার সামনেই একটি দোকান চালাতেন। দোকানে নিজেই চা বানাতেন আর মারিয়াম বাজার থেকে কেনা চা–পাতা বিভিন্ন চায়ের দোকানে বিক্রি করতেন। তবে ব্যাপক করোনা সংক্রমণকালে অনেক দোকানি টাকা ফেরত দিতে পারেননি। পুঁজির অভাবে জুতার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখন মানুষের কাছে অন্তত তিন লাখ টাকা পাওনা ছিল।
মারিয়াম বলেন, ‘আমরা দুজনেই বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি। বাড়িভাড়া, খাওয়াদাওয়ায় জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। সংসার চালাতে কাজ খুঁজতে থাকি। চড়া সুদে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিই। চেনা–পরিচিতদের কাছ থেকে করা ধারদেনা পরিশোধ করতে পারছিলাম না বলে সবাই একটু খারাপ চোখে দেখা শুরু করে। সব মিলিয়ে খুব হিমশিম খাচ্ছিলাম।’
উবারে গাড়ি চালানোর চিন্তা
মারিয়াম বলেন, ‘আমরা ঋণে ডুবে গেছি। অবস্থা এমন হয়েছিল যে স্বামীর মাস্টার্সের ফরম পূরণ করলে আমার পড়াশোনা স্থগিত করতে হবে। তাই আমি পড়াশোনায় একটু বিরতি নিই। কিছু একটা করার চিন্তা শুরু করি। ইউটিউব ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারলাম, উবারে গাড়ি চালালে কম করে হলেও দিনে ২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। স্বামীকে বললাম, উবারে গাড়ি চালাব।’
মারিয়াম আরও বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি খুব দুরন্ত। যেকোনো বাগানে ছেড়ে দিলে লাফ দিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে পারি। ছোটবেলায় সুযোগ পেলে ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। এ জন্য ভাইয়ের মারও খেতে হতো। যা–ই হোক, গাড়ি চালানোর কথা শুনে স্বামী প্রথমে একটু অবাক হন। তারপর এলাকায় একটি ট্রেনিং সেন্টার এবং আঞ্জুমান মুখলেছুর রহমান ইনস্টিটিউট থেকে মাত্র এক হাজার টাকা প্যাকেজে ছয় মাস গাড়ি চালানো শিখি।’
মারিয়াম বলেন, ‘গাড়ি চালানো শেখার পর মনে হলো নিজের গাড়ি ছাড়া চলবে না। কিন্তু টাকা পাবো কোথায়? বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণের আবেদন করলেও সহজে ঋণ মিলছিল না। ঘুরতে ঘুরতে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে করোনায় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা তহবিল থেকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ৪ লাখ টাকা পাই। এ টাকা থেকে স্বামীর চায়ের দোকানে প্লাস্টিক পণ্য ও অন্যান্য ক্রোকারিজ দিয়ে সাজানো হয়। আবার কিছু ঋণ করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে পুরোনো একটি গাড়ি কিনি।
আর পেছনে তাকাতে হয়নি
উবারে গাড়ি চালানো শুরুর পর মারিয়ামকে আর খুব একটা পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হাসিমুখে তিনি বলেন, ১১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি আরেকটি গাড়ি কেনার চেষ্টায় আছেন। এ গাড়িতে উবারে প্রিমিয়াম (উন্নত মানের গাড়ি) ভাড়া পাবেন।
উবারের নিয়ম অনুযায়ী, একজন চালক ১২ ঘণ্টার বেশি সময় গাড়ি চালাতে পারেন না। প্রতি ট্রিপে ২৫ শতাংশ কমিশন ও ভ্যাট কেটে রাখে।
মারিয়াম বলেন, উবারে গাড়ি চালানো শুরুর আগে দিনে ১ হাজার টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখতেন। কাজ শুরুর পর বুঝলেন, স্বপ্নের পরিধিটা বাড়ানো যায়। পরিশ্রম করতে পারলে আয় বাড়বে।
ঋণ শোধ করার পাশাপাশি মারিয়ামের সংসারে খরচও বেড়েছে। সন্তানের দেখভালের জন্য বাসায় সহকারী রাখতে হয়েছে। দোকানভাড়া দিতে হচ্ছে সাত হাজার টাকা। বাসাভাড়া ১৮ হাজার টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের পড়াশোনা, বাচ্চার খাবারসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই।
মারিয়ামের স্বামী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, সেখানেই ব্যবসায় প্রশাসনের মাস্টার্সে ভর্তি হন। চাকরির জন্য আবেদন করছেন, পরীক্ষা দিচ্ছেন। দোকানে বসে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মারিয়াম সংসার চালানো, পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাচ্ছেন।
নারীচালক হিসেবে উবারে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে মারিয়াম বলেন, যাত্রীরা গাড়িতে চড়ে অবাক হন। যাত্রীদের মধ্যে অনেক ছেলে-মেয়ে তাঁকে গাড়ি চালাতে দেখে নিজেরাও উৎসাহিত হন।
শ্বশুরবাড়িতে গেলে অনেকে দেখতে আসেন
মারিয়ামের শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলে। গাড়ি চালিয়েই স্বামী-সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যান। তখন প্রতিবেশীদের অনেকে তাঁর স্বামীর নাম ধরে বলেন, নাসিরের বউ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি আসছে। অনেকেই ‘গাড়িচালক বউ’ দেখতে বাড়িতে আসেন। তখন শাশুড়ি বেশ গর্বিত হন। সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলেও গল্প করে, তার মা গাড়ি চালায়।
চালকদের পরিবারে শান্তি থাকলে দুর্ঘটনা ঘটবে না
রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হয়, নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন কি না, এমন প্রশ্নে মারিয়াম বলেন, উবারের কাছে আমার ও গাড়ির যাত্রীর সব তথ্য থাকে। গাড়ি কিছুক্ষণ জ্যামে আটকে থাকলেও উবার থেকে এসএমএস করে জানতে চায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। গাড়ি চালাতে গিয়ে বিপদে পড়লে চালক ও যাত্রীর জন্য নিরাপত্তা বাটন আছে। সব মিলিয়ে কখনো ভয় লাগে না। তা ছাড়া এ পর্যন্ত বাজে কোনো পরিস্থিতির মুখেও পড়েননি তিনি।
মারিয়াম জানালেন, তাঁর মুঠোফোন নম্বরটি অনেক যাত্রীর হাতে চলে যাচ্ছে। পরে কেউ কেউ ফোন করে কথা বলতে চান বা বাজে ইঙ্গিত করেন। তবে সংখ্যাটা খুবই কম।
এ পর্যন্ত বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হননি মারিয়াম। বললেন, চালক শিক্ষিত হলে, মাথা ঠান্ডা থাকলে, পরিবারে শান্তি থাকলে, চালকের ধৈর্য থাকলে এবং মুঠোফোনে কথা না বললে কখনোই বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা জরুরি।
স্বামীকে কথা শুনতে হয়
স্ত্রী গাড়িচালক বলে স্বামী নাসিরকে অনেকের কাছে অনেক কথাই শুনতে হয়। তবে নাসির কারও কথা গায়ে মাখেন না। বলেন, মানুষের কথায় কান দিলে তো সংসার চলবে না। তিনি একবাক্যেই স্বীকার করেন, তাঁর চেয়ে স্ত্রী বেশি পরিশ্রম করে সংসারটা টিকিয়ে রেখেছেন।
মারিয়ামের স্বপ্নটা বড় হয়েছে। গাড়িচালক হিসেবে উবারে যাত্রীরা তাঁকে ৪ দশমিক ৮৪ রেটিং দিয়েছেন। নতুন গাড়ি পেলে পুরোনো গাড়িটা ভাড়া দেবেন। আয়ের পরিমাণ আরেকটু বাড়লে আরেকটি গাড়ি কিনবেন।
উবারের বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের প্রধান আরমানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৬ সালে বাংলাদেশে উবারের কার্যক্রম শুরুর পর ১০০ জনের বেশি নারীচালক উবারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য, নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষের কাজে যে ভেদাভেদ বা ট্যাবু আছে, তা দূর করা।
এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নারী-পুরুষে সমতা তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। নারীরা যাতে এ প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে নিজেদের পছন্দমতো কাজ করতে পারেন, সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’