আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় নিয়ে ভিন্ন তথ্য
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে যত সেবা রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে আইসিটির পরিমাণ ১০ শতাংশ।
ভারতের ক্ষেত্রে তা ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর শ্রীলঙ্কার ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
সরকার বলছে, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের রপ্তানি আয় প্রায় ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংখ্যাটি সর্বোচ্চ দেড় বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে রপ্তানির হিসাব রাখা সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, আইসিটি খাতের রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন ডলারও হয় না।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলে আসছেন, দেশের আইসিটি খাতের রপ্তানি প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। তিনি আগামী ৫ বছরে এ খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির প্রত্যাশা করছেন। আইসিটি খাতের রপ্তানির তথ্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, হার্ডওয়্যার ও ফ্রিল্যান্সিং খাতের তথ্যের ভিত্তিতে এ হিসাব। এ ছাড়া চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) কিছু কোম্পানি ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে থাকেন এটা নাকি আরও ১ বিলিয়ন ডলার বেশি হবে। এ ছাড়া অনানুষ্ঠানিকভাবেও কিছু রপ্তানি হয়। প্রায় ২ বিলিয়নের হিসাব তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলে থাকেন।
সরকার বলছে, এ খাতের রপ্তানি আয় প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সর্বোচ্চ দেড় বিলিয়ন ডলার।
দেশের পণ্য ও সেবা রপ্তানির তথ্য মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) দিয়ে থাকে। আইসিটি খাতের রপ্তানির মধ্যে সেবা খাতই এগিয়ে। সরকারি নথিপত্রে এর লিখিত হিসাব পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার ও তথ্যসেবা অর্থাৎ আইসিটি সেবা রপ্তানির পরিমাণ ৫৩১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশ কম।
অন্যদিকে ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, একই অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আইসিটি সেবা রপ্তানি হয়েছে ৪৭৭ মিলিয়ন ডলার; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার কম।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে যত সেবা রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে আইসিটির পরিমাণ ১০ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রে তা ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ। পাকিস্তানের ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
রপ্তানি পাঁচ বিলিয়ন ডলারের যে স্বপ্ন, তা এমনি এমনি হয়ে যাবে না। এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা লাগবে।রাসেল টি আহমেদ, সভাপতি, বেসিস
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের আইসিটি খাতের রপ্তানির ৮০ ভাগই সেবাভিত্তিক। আর এই সেবা রপ্তানির পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের অর্ধেক। সব মিলিয়ে আইসিটি খাতের রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের কম হবে। দুই বছর ধরে এই রপ্তানি কমছে। ফলে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের যে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভব কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদের মতে, আইসিটি খাতের রপ্তানি প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খাতের অনেকের তথ্যই যুক্ত হয় না। পোশাক শিল্প খাতের পর আইসিটিকে বড় সম্ভাবনায়মহ খাত হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু গত দুই বছরে অগ্রগতি দেখা যায়নি। প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হয়নি। ৫ বিলিয়ন ডলারের যে স্বপ্ন, তা এমনি এমনি হয়ে যাবে না। এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা লাগবে।
আইসিটি খাতে ফ্রিল্যান্সারদের সঠিক সংখ্যার হিসাব পাওয়া যায় না। আবার তাঁদের থেকে ঠিক কত আয় হয়, তারও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দেশের একজন শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ কেউই সঠিকভাবে বলতে পারবেন না। ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা ছয় থেকে সাত লাখ হবে। কিন্তু মূলত কাজ করে দেড় লাখের মতো।
বেসিস-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের ফ্রিল্যান্সারদের রপ্তানির পরিমাণ ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) সভাপতি তানজীবা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন ডলার। আর তিনি মনে করেন, আইসিটি খাতের রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলার হবে।
সেবা ছাড়াও আইসিটির নানা পণ্য আছে। বিশ্বব্যাংকের আইসিটি পণ্য রপ্তানির হিসাবে ২০১৫ সালের পর বাংলাদেশের তথ্য নেই।
আইসিটি পণ্য হিসেবে কোনগুলোকে ধরা হয়, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ওয়েবসাইটে। সেখানে আইসিটি পণ্যের তালিকায় আছে কম্পিউটার ও পেরিফেরাল যন্ত্রপাতি, যোগাযোগ সরঞ্জাম, ভোক্তা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম (সাউন্ড রেকর্ডিং, মাইক্রোফোন, যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, টেলিভিশন ক্যামেরা, হেডফোন, ভিডিও গেম সরঞ্জাম, রেডিও ব্রডকাস্ট সরঞ্জাম ইত্যাদি), বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, সেমিকন্ডাক্টর মিডিয়া প্রভৃতি।
আইসিটি খাতের রপ্তানি প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো হবে।বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে আইসিটি পণ্যের আলাদা কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২-২৩ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের কথা উল্লেখ আছে; যা রপ্তানির পরিমাণ ৫৮৫ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত হিসাবে তা ৪৭৯ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার।
ইপিবির ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের তালিকায় আছে আয়রন স্টিল, কপার ওয়্যার, স্টেইনলেস স্টিল ওয়্যার, ইঞ্জিনিয়ারিং ইকুইপমেন্টস, ইলেকট্রিক পণ্য, বাইসাইকেলসহ অন্যান্য পণ্য। আঙ্কটাডের আইসিটি পণ্যের ব্যাখ্যা অনুসারে, বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের মধ্যে ইলেকট্রিক পণ্য বাদে আর কোনোটিই পড়ে না। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য ও আইসিটি সেবা খাতের মোট রপ্তানির পরিমাণ হিসাব করলে তা এক বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর আইসিটি খাতের রপ্তানি প্রসঙ্গে বলেন, টিভি–ফ্রিজের মতো ইলেট্রনিক পণ্যকে আইসিটি পণ্য হিসেবে ধরা ঠিক না। তিনি মনে করেন, আইসিটি খাতে রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারের কম হবে। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আইসিটি খাতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা উদ্যোগের কাজ হচ্ছে। তবে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। সরকারকে এখানে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। পাঁচ বিলিয়ন করতে গেলে অন্তত ১৫০ বড় কোম্পানি গড়ে তুলতে হবে।