সাত-সাতবার টানাহেঁচড়ার পর অবশেষে নাম পেল পার্কটি। প্রায় সাত বছর ধরে নাটকীয় ঘটনার পর গত ২৪ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে লেখা হয়েছে ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’। তার আগে এটি ঘুরপাক খায় খুলনা ডিসি পার্ক, মুক্তিযোদ্ধা পল্লী, বঙ্গবন্ধু ইকোপার্ক, শেখ রাসেল ইকোপার্ক, জেলা প্রশাসন পার্ক ও খুলনা ইকোপার্ক নামের চক্রে। মূলত মালিকানা দখলের চেষ্টাতেই এসব ঘটনা ঘটায় খুলনা জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনার এই আলোচিত পার্কটি কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে নানা কৌশল করেছে জেলা প্রশাসন। দরকার পড়লেই তারা ‘বঙ্গবন্ধু’র ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষ হটিয়েছে; আবার নামের সঙ্গে ‘ইকোপার্ক’ জুড়ে দিয়ে জলবায়ু তহবিলের টাকা এনেছে। এই সুযোগে বন বিভাগ আবার প্রকল্প তৈরি করে পার্কের কর্তৃত্ব নিয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল গত বছরের জুন পর্যন্ত। কিন্তু তার আগেই ২০২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর পার্কের উদ্বোধন সেরে ফেলে জেলা প্রশাসন। বন বিভাগকে না জানিয়েই তড়িঘড়ি করে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
সাবেক প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রথম আলোকে জানান, পার্কটি উদ্বোধনের কোনো তথ্য বন বিভাগকে জানানো হয়নি। পার্কে বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার যাবেন, শুধু এ কথা জানানো হয়েছিল। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসবেন, সে জন্য তাঁকে সেখানে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি গিয়ে দেখেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবং খুলনার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত আছেন।
ওই সময় খুলনার জেলা প্রশাসক ছিলেন খন্দকার ইয়াসির আরেফীন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (উপসচিব) হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার পরও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন ও প্রকল্প পরিচালককে তা না জানানোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মুফোঠোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তবে তাঁকে এ ব্যাপারে জানানো হয়েছিল কি না তা জানি না।’
এত সব ঘটনার পরও পার্কটির মালিকানার চূড়ান্ত মীমাংসা এখনো হয়নি। মাঝখান থেকে খরচ হয়ে গেছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলছেন ‘অন্যায়, অপচয়’।
চিঠি দিয়ে শুরু
খুলনার এই বহুল আলোচিত পার্কটির প্রতিষ্ঠা ও নামকরণের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যায়, ২০১৬ সালের মে মাসে খুলনা বিভাগের প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি পাঠান তৎকালীন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সামাদ। চিঠিতে জেলায় পড়ে থাকা খাসজমিতে একটি করে ‘জেলা প্রশাসন ইকোপার্ক’ তৈরির আহ্বান জানান তিনি। চিঠিতে বলা হয়, খুলনা বিভাগের প্রতিটি জেলায় প্রচুর খাসজমি আছে। অদূর ভবিষ্যতে এসব খাসজমি সম্পূর্ণই সরকারের বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সেখানে ইকোপার্ক করা হলে পর্যটক আকৃষ্ট হবে এবং বিনোদন ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। পার্কটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৭ কোটি টাকা। পার্কটির নির্মাণকাজ এখন শেষ পর্যায়ে।
ওই চিঠি পাওয়ার পর জমি খুঁজতে শুরু করে খুলনার জেলা প্রশাসন। কাজিবাছা নদীর তীরে বটিয়াঘাটা উপজেলার মাথাভাঙ্গা মৌজার ১৭ দশমিক ৬৭ একর ও রূপসা উপজেলার জাবুসা মৌজার ১৮ দশমিক ১৯ একর মিলে মোট ৩৫ দশমিক ৮৬ একর খাসজমিতে ইকোপার্ক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ওই জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর ২০১৭ সালের মার্চ থেকে বন বিভাগ, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে পার্ক উন্নয়নের জন্য অনুরোধ করেন খুলনার জেলা প্রশাসক। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে নদীর ধারে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দেওয়া হয়। পার্কের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে দেড় কোটি টাকা চেয়ে পাওয়া যায় এক কোটি। সেটা দিয়ে পার্কের মধ্যে বহুতল ভবনের ভিত তৈরি করা হয়।
নজর জলবায়ু তহবিলে
একপর্যায়ে তহবিলে টান পড়লে পার্কটি নির্মাণ ও বনভূমি সৃষ্টির জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কাছে প্রস্তাব দেয় খুলনা জেলা প্রশাসন। প্রস্তাবটি বন অধিদপ্তর হয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে যায়। মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে ৮ কোটি ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, খুলনা জেলায় এখন পর্যন্ত এই পার্কসহ আরও ৭টি প্রকল্পে জলবায়ু তহবিলের মোট বরাদ্দ এসেছে ৬০ কোটি ৩২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
তবে প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে ওই খাসজমি তাদের আওতায় দেওয়ার আবেদন করে বন বিভাগ। কিন্তু ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে খুলনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, বন বিভাগ, পর্যটন করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জেলা পরিষদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিন, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বটিয়াঘাটা ও রূপসা উপজেলা এবং খুলনা জেলা প্রশাসনের সমন্বিত তত্ত্বাবধানে পার্কটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাই এটি এককভাবে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পার্কটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।
নাম পাল্টায় ৭ বার
প্রথমে জেলা প্রশাসন পার্কটির নাম রাখে ‘খুলনা ডিসি পার্ক’। হঠাৎ ওই জমিতে নজর পড়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের। পার্কের বদলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা পল্লী করার দাবি ওঠে। দখলে নেওয়ারও চেষ্টা চলে। বিপদ দেখে জেলা প্রশাসন তড়িঘড়ি করে নাম পাল্টে রাখে ‘বঙ্গবন্ধু ইকোপার্ক’। ধাক্কা খেয়ে পিছটান দেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরে ওই নামের অনুমতির জন্য নিয়মমাফিক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদন করতে হয় জেলা প্রশাসনকে। আবেদন পেয়ে ট্রাস্ট আবার ‘বঙ্গবন্ধু’ কেটে দিয়ে জুড়ে দেয় ‘শেখ রাসেল’। এরপর থেকে কাগজে-কলমে পার্কটি চলছিল ‘শেখ রাসেল ইকোপার্ক’ নামে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পার্কের প্রবেশমুখের নামফলক থেকে ‘শেখ রাসেল’ লেখা অংশ ভেঙে ফেলা হয়; দেয়ালে দেয়ালে কালো কালি দিয়ে লেখা হয় ‘জেলা প্রশাসন পার্ক’।
ওই ঘটনার পর আবার পার্কটির মালিকানা দাবি করে বসে বন বিভাগ। শুরু হয় চিঠি চালাচালি। দুই সংস্থার দুজন প্রতিনিধি দেখভাল করতে থাকেন পার্কটির। নিরাপত্তারক্ষী ও নৈশপ্রহরীও থাকে দুই পক্ষেরই। জেলা প্রশাসন বলে, এবার পার্কের নাম হবে ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’। আর বন বিভাগ চায়, নাম হোক ‘খুলনা ইকোপার্ক’। সবশেষে গত ২৪ ডিসেম্বর পার্কের সামনে ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’ নামফলক টানিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। এর আগে ৩ অক্টোবরের বৈঠকে পার্ক ব্যবস্থাপনা কমিটি শেষমেশ এই নামটিই অনুমোদন করেছে। নাম সংশোধনের চিঠিও পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে। খুলনা জেলা প্রশাসন ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
মালিকানা নিয়ে টানাটানি
সর্বশেষ গত বছর ১৪ মে ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে পার্কটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবি করা হয়েছিল। এরপর ৩ নভেম্বর একই মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে পার্কটি জেলা প্রশাসনের অধীনে থাকা উচিত বলে দাবি করেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার।
পার্ক নির্মাণে সরাসরি যুক্ত ছিলেন খুলনার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম। তিনি এখন খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেহেতু বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে পার্কটির উন্নয়ন করেছে, তাই পার্কটি শুধু বন বিভাগের কাছে ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, পার্কটি আগে কীভাবে তৈরি হয়েছে তা জানা নেই। তবে ৫ আগস্টের পর সেখানে অন্য কেউ বিনিয়োগ করেনি বা কারও কাছ থেকে কোনো অনুদান নেওয়া হয়নি।
পার্কটির প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন চারজন। শুরুর দিকে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বর্তমান প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। তখন তিনি খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বদলি হয়ে গেলে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান খুলনা অঞ্চলের আরেক বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান। এখন তিনি উপপ্রধান বন সংরক্ষক। আমীর হোসাইন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে মঈনুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু তহবিলের টাকা এই প্রকল্পের মধ্যে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
খুলনা অঞ্চলের বর্তমান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো যুক্তি দেখান, ‘পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ম্যান্ডেটের মধ্যে ইকোপার্ক স্থাপনের কথা রয়েছে। তাই জলবায়ু তহবিলের টাকা দেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রজ্ঞাপন মূলেই ইকোপার্কের ধারণা নির্ধারিত হয়েছে। যেহেতু সেই উদ্দেশ্যেই সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, সেহেতু এটা যেন ইকোপার্ক হিসেবেই বজায় থাকে, সেটাই আমার প্রত্যাশা।’
গত জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে মন্ত্রণালয় থেকে আর তা বাড়ানো হয়নি। তাই এখন কোনো প্রকল্প পরিচালক নেই। পার্কটির সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন। গত অক্টোবরে তিনি টাঙ্গাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন। যোগাযোগ করলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বন বিভাগ যখন পার্কে বনায়নের দায়িত্ব পায়, তখন সেটি ছিল পরিত্যক্ত একখণ্ড জমি। পরে জলবায়ু তহবিলের টাকায় ওই পার্কে ৩ হাজার ২৫০টি বনজ ও ফলদ, ২ হাজার ৭৫০টি বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি, ৪ হাজারটি সৌন্দর্যবর্ধক ও ৪ হাজারটি ম্যানগ্রোভ চারা লাগানো হয়। তৈরি করা হয় লেক ও হাঁটাচলার পথ।
জলবায়ুর টাকা অপচয়
নামের সঙ্গে ‘ইকোপার্ক’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও শুরু থেকেই পার্কের মধ্যে ফিশিং জোন, কিডস কর্নার, সুইমিংপুল, মেরিন ড্রাইভ, ফুটট্রেইল, ট্রেন, ঝুলন্ত ব্রিজ, ওয়াটার ব্রিজ, প্লে গ্রাউন্ড, ফুড জোন, এম্পিথিয়েটার, অবজারভেশন টাওয়ার ইত্যাদি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
এমন একটি বিনোদন ও বাণিজ্যিক পরিকল্পনায় জলবায়ু তহবিলের টাকা খরচের বিষয়টি তুলে ধরলে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চের (সিইপিআর) চেয়ারপারসন গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা মূলত খরচ করার কথা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপন্ন মানুষের সহায়তায় বা বিপন্নতার সঙ্গে তাঁদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। এই টাকা দিয়ে পার্ক তৈরি করা যেতে পারে না। পার্কের নামে জলবায়ু ফান্ডের টাকার অপচয় করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমানও প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এ প্রকল্প গ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিলের টাকা মূলত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য খরচ করার কথা থাকলেও তা না করে পার্কের নামে সেই টাকা লুট করা হয়েছে।
খরচের সঙ্গে বাস্তবের অমিল
জেলা প্রশাসক অফিসে গত বছরের পাঠানো প্রতিবেদনে পার্কে গত বছরের জুন পর্যন্ত গাছ লাগানো, অবকাঠামো তৈরি, আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি কেনা, লেক ও জলাশয় খনন এবং গাছ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বন বিভাগ ৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে হিসাব দেখিয়েছে। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই খরচের হিসাব মেলানো যায়নি। পার্কে ১৪ হাজার গাছ লাগানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ছোট-বড় কিছু ঝাউগাছ, কাঠবাদাম ও কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ লাগোনো হয়েছে। এর বাইরে অল্প কিছু হরীতকী, বহেরা, বকুল, জারুল, শুমরালি, দেবদারু ও কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো হয়েছে। আর খই বাবলা, নিমসহ আরও কিছু গাছের বীজ ছিটিয়ে চারা গজানো হয়েছে।
পার্কে কী কী গাছ কত সংখ্যক করে লাগানো হয়েছে ও গাছ লাগানোর খরচের হিসাব বন বিভাগের কাছে চেয়েও পাওয়া যায়নি। তথ্য জানতে চাওয়ায় বন কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ বিরক্তিভাব দেখা গেছে।
পার্কের লেকের জন্য তিনটি প্যাডেল বোট কেনার কথা ছিল। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু আদতে প্রকল্প থেকে কোনো বোট কেনাই হয়নি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তিনটি বোট কিনেছে জেলা প্রশাসন, মাত্র এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
দুটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের (পর্দাসহ) জন্য খরচ ধরা হয়েছিল এক লাখ টাকা। ডিজিটাল ক্যামেরার জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ হাজার টাকা। একটি গভীর নলকূপ কেনা ও স্থাপনের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ৫ লাখ টাকা। পার্ক অফিসের আসবাবপত্র কেনার জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ৩ লাখ টাকা। কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ইন্টারনেট, প্রজেক্টর, প্রিন্টার, ইউপিএস এবং খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার জন্য বরাদ্দ ছিল ২ লাখ টাকা।
গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের বিভিন্ন সময় অন্তত ছয়বার পার্কটি ঘুরে সেখানে কোনো মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ক্যামেরা, আসবাবপত্র, কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইউপিএস দেখা যায়নি। পার্কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মো. আরিফুজ্জামান বলেছেন, এসব কোনো কিছুই তাঁরা কখনো দেখেননি।
প্রকল্প পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, এগুলো বন বিভাগের অফিসে আছে। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের কার্যালয়ে গেলে সেখানকার কর্মকর্তারা দুটি কম্পিউটার, দুটি প্রজেক্টর, একটি প্রজেক্টরের পর্দা, একটি ক্যামেরা ও বেশকিছু আসবাব দেখান। দেখা যায়, কম্পিউটার দুটি দুজন ব্যবহার করছেন, যা একেবারেই নতুন। প্রজেক্টর, ক্যামেরা ও আসবাবপত্রও একেবারে নতুন। কোনো কোনোটি এখনো বাক্স থেকে খোলাই হয়নি।
পার্ক কার্যালয়ে পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পাশেই একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের নলকূপ স্থাপন করে এমন দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হয় দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা। অন্য কোনো বাড়তি কাজ থাকলে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকার মধ্যেই সেটা করা সম্ভব। তবে এ খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ৫ লাখ টাকা।
খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের চিঠির আলোকে কিছুদিন আগে তাঁরা বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে নিয়ে পার্কের বিষয়ে বৈঠক করেন। সেখানে পার্কটি ইকোপার্ক, না বিনোদন পার্ক হবে, সে প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে। তবে শেষে সবাই সর্বসম্মতিক্রমে ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’ নামকরণের পক্ষে মত দেন। পরে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে মতামতটি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, একটি ইকোপার্ক হওয়ার জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার, তা এই পার্কে নেই।