ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। আবার রাশিয়াও এ প্রতিযোগিতায় যুক্ত হয়েছে। অতীতে এই চার দেশের সঙ্গে নানা মাত্রায় সুসম্পর্ক রেখে চলেছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে হেলে না পড়ে, সে জন্য ট্রাম্প প্রশাসন চাপ দিতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ভূরাজনীতিবিষয়ক এক প্যানেল আলোচনায় ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান এ মন্তব্য করেন। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর জিওপলিটিক্যাল ইনসাইটস ‘বাংলাদেশ অ্যাট জিওপলিটিক্যাল ক্রসরোডস’ (ভূরাজনীতির সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ) শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। সঞ্চালনা করেন জিওপলিটিক্যাল ইনসাইটসের সম্পাদক রামিসা রব।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশে গত ছয় মাসে অনেক কিছু ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের পররাষ্ট্রনীতি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা চাপের মুখে রয়েছে। কারণ, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বড় চার দেশ একে অন্যের সঙ্গে নানাভাবে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কেমন আচরণ করবে, তা অজানা। তবে বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে হেলে না পড়ে, সে জন্য ট্রাম্প প্রশাসন চাপ দিতে থাকলে বাংলাদেশকেও কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ভূরাজনীতি টেকসই নয়, অনিশ্চিত। এই অনিশ্চিত ভূরাজনীতিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রভাব ফেলবে। অনিশ্চিত ভূরাজনীতি অনেক সময় কিছু দেশের জন্য সুফলও বয়ে আনে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গতবার ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ বয়ে এনেছিল। তবে তা আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। কারণ, আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। সেই বাস্তবতায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা এখনো প্রস্তুত নই।’
আলোচনায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরের প্রসঙ্গ এলে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার চীনের দিকে ঝুঁকছে। আমরা জানি না চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে মোকাবিলা করবে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন কৌশলগত বিষয়গুলো কম গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগী হবে বলে মনে হয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্কে বাধা তৈরিতে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে বাংলাদেশের ওপর চাপ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফর ইতিবাচক হয়েছে বলেই মনে করি। তবে বাংলাদেশে আমরা আরও চীনা বিনিয়োগ দেখতে চাই।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো শাফকাত মুনীর গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যালোচনার জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে, আমাদের কী ধরনের পররাষ্ট্রনীতি থাকা দরকার এবং আমাদের বিদ্যমান কাঠামোটি কী, এ ধরনের সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য প্রস্তুত কি না, তা বিবেচনায় নিতে হবে।’
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার প্রচেষ্টায় রয়েছে। ভারত বাংলাদেশে একটি নির্বাচন দেখতে চায়। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। ভারত মনে করছে, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
প্যানেল আলোচকদের কাছে মাহ্ফুজ আনাম প্রশ্ন রাখেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। জবাবে সেলিম রায়হান বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমাদের ভারতের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের পথেই এগোতে হবে। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক আস্থা আর বিশ্বাসের ভিত্তিতে।’
শাফকাত মুনীর বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা হবে গঠনমূলক ও ইতিবাচক পথে, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে সময়ের দাবির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পারস্পরিক আস্থা আর শ্রদ্ধার ভিত্তিতে।
আলোচনায় অংশ নেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক মারুফা আক্তার, সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক করিম, মুন্সি ফয়েজ আহমেদ প্রমুখ।