‘শেষ দিন মনে কইরা তখনই “ইন্না লিল্লাহ...” পইড়া ফালছি’

এই রিকশায় করেই গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজের নিথর দেহ নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছিলেন রিকশাচালক মোহাম্মদ নুরু। রিকশাটি তিনি পরে বিক্রি করে দেনছবি: মানসুরা হোসাইন

পুলিশ গালি দিয়া কয় তোল। কী তুলব? সেইখানে একটা টুকরি ছিল। বলি, টুকরি তুলব? আবার পুলিশ গালি দিয়া কয়, লাশটা তোল। গুলি লাইগ্যা ছেলেটা সেইখানে উবু হইয়্যা পইড়া ছিল। আমি পেছন সাইড ধরি। পুলিশ পা ধইরা রিকশার পাদানিতে ফিক্কা মারে। পুলিশ আমারেও গুলি করবার চায়। টুকরিত ভইরা ছেলেটারে আর আমারে পুইড়া ফালাইতে চায়। শেষ দিন মনে কইরা তখনই আমি ‘ইন্না লিল্লাহ...’ পইড়া ফালছি।

কথাগুলো রিকশাচালক মোহাম্মদ নুরুর। পরিচিতজনদের কাছে নুরু নামেই তিনি পরিচিত। নুরু যে ছেলেটার কথা বলছিলেন সে ১৭ বছর বয়সী গোলাম নাফিজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৪ আগস্ট রাজধানীর ফার্মগেটের পদচারী–সেতুর নিচে গুলিবিদ্ধ হয় নাফিজ। রিকশার পাদানিতে তার পতাকা বাঁধা মাথা একপাশে ঝুলে আছে, আরেক পাশে নিস্তেজ পা দুটো ঝুলছে। রিকশার চেইনের সঙ্গে পেঁচিয়ে যাচ্ছিল বলে নুরু নাফিজের হাত রিকশার রডের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। চারপাশে তখন অনেক মারমুখী পুলিশ। চলছিল বৃষ্টির মতো গুলি। সেই অবস্থাতেই নাফিজের নিথর দেহ নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছোটেন নুরু।

মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই মুহূর্তের কিছু ছবি তুলেছিলেন। তাঁর তোলা ছবি পত্রিকায় দেখেই (৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার পর) নাফিজের মা–বাবা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে লাশ পেয়েছিলেন ছেলের।

জীবনের সেদিনের তোলা ছবি দেশ–বিদেশে আলোচিত হয়। একই সঙ্গে নুরুও গণমাধ্যমের নজর কাড়েন। নুরু বলছিলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অনেকেই তাঁকে চেনেন। সাংবাদিকেরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

গোলাম নাফিজ (১৭) ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৪ আগস্ট ফার্মগেটের পদচারী–সেতুর নিচে গুলিবিদ্ধ হয়। রিকশার পাদানিতে নাফিজের পতাকা বাঁধা মাথা একপাশে ঝুলে আছে, আরেক পাশে নিস্তেজ পা দুটো ঝুলছে। রিকশার চেইনের সঙ্গে পেঁচিয়ে যাচ্ছিল বলে নুরু নাফিজের হাতটা রিকশার রডের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন চারপাশে ছিল অনেক মারমুখী পুলিশ। চলছিল বৃষ্টির মতো গুলি।

নুরু বললেন, পুলিশ রিকশায় তুলে দেওয়ার পর একটু দূরে গিয়ে তিনি চাইলে নাফিজকে ফেলে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু মনে হয়েছে, এই ছেলেটা তো তাঁর সন্তান বা ভাই হতে পারত। নুরু নাফিজের পরিচয় পরে জানতে পেরেছিলেন।

‘অনেকেই বলে সেই দিন গ্যাঞ্জামের মধ্যে রিকশা নিয়া কেন বাইর হইছিলাম। পেটে তো খিদা, রিকশা না নিয়া বাইর হইলে খাব কী? এই রিকশা চালাইয়্যাই তো আমার সংসার চলে’, বলেন নুরু।

মোহাম্মদ নুরু কিছুদিন ফার্মগেটের এই জায়গায় গিয়ে বসে থাকতেন। তাকিয়ে থাকতেন নাফিজ যেখানে উবু হয়ে পড়ে ছিল, সেই জায়গাটার দিকে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

সেদিনের ঘটনা

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা হয় নুরুর সঙ্গে। ফার্মগেটসহ সেদিন নাফিজকে নিয়ে নুরু যেসব জায়গায় গিয়েছিলেন, তিনি সেসব জায়গা তাঁর রিকশায় করে প্রতিবেদককে ঘুরিয়ে দেখান। ঘাড় ঘুরিয়ে বলছিলেন, ছেলেটার গলায় আইডি কার্ড ছিল। তা–ও ফেলে দেয় পুলিশ। কোনো ফোন নম্বর ছিল না, ফোন নম্বর পেলে তখনই ছেলেটার মা–বাবাকে একটু খবর দেওয়া যেত। তখনো ছেলেটা বেঁচে ছিল কি না, কে জানে।

রিকশার পেছনে নুরুর মুঠোফোন নম্বরটা লেখা ছিল। জীবন আহমেদের তোলা রিকশার ছবি দেখে ঘটনার পরের দিন মুঠোফোন নম্বরটিতে নাফিজের মামা আবুল হাশেম নুরুকে ফোন দেন। তারপর নাফিজের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আয়োজিত মিলাদে অংশ নেন নুরু। নিজেই নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ও মা নাজমা আক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। জানালেন, তাঁরা তাঁকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তবে নেননি। পরে নুরুর ছেলেমেয়ের জন্য দিয়েছেন বললে তিনি সেই টাকা নিতে রাজি হন।

অনেকেই বলে সেই দিন গ্যাঞ্জামের মধ্যে রিকশা নিয়া কেন বাইর হইছিলাম। পেটে তো খিদা, রিকশা না নিয়া বাইর হইলে খাব কী? এই রিকশা চালাইয়্যাই তো আমার সংসার চলে।
মোহাম্মদ নুরু, রিকশাচালক

ফার্মগেটের পদচারী–সেতুর নিচে বসে নুরু সেদিনের (৪ আগস্ট) ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সেদিন সংসদ ভবনের কোনায় মারামারি হচ্ছিল। রিকশা নিয়ে উল্টো পথে চলে যান তিনি। মগবাজার যেতে চান এক যাত্রী। তাঁকে নিয়ে ফার্মগেট পুলিশ বক্স পাড়ি দেবেন, তখন বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়। সে অবস্থাতেই বিজ্ঞান কলেজের সামনে পর্যন্ত চলে যান নুরু। সেখান থেকে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে পুলিশ তাঁকে পদচারী–সেতুর কাছে নিয়ে আসে।

নুরু বলেন, নাফিজকে রিকশায় তোলার পর প্রথমে তাঁকে ফার্মগেটের আল-রাজী হাসপাতালে নিতে বলে। সেই হাসপাতালের সামনের অবস্থাও খারাপ। সেখানে নিলে আরেক পুলিশ রিকশা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, না হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। নুরু নাফিজকে নিয়ে খামারবাড়ির ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান। হাসপাতাল থেকে একটু দূরেই সেনাবাহিনী ছিল। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্য ও আরও কয়েকজন মিলে একটি অটোরিকশায় তুলে দেন নাফিজকে। অটোরিকশা ছোটে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দিকে।

বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে ইউনিফর্ম পরা গোলাম নাফিজ
ছবি: সংগৃহীত

নুরু আক্ষেপ করে বলছিলেন, সেদিন কেউ যদি একটু নাফিজকে ধরত তবু রিকশাটা দ্রুত চালাতে পারতেন। কিন্তু রিকশায় পড়ে থাকা নাফিজকে কেউ ধরতে আসেননি। গুলির শব্দে নুরুর নিজের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। নাফিজকে অটোরিকশায় তুলে দেওয়ার পর চক্ষু হাসপাতালের কাছেই এক লেবুর শরবত বিক্রেতার কাছ থেকে দুই গ্লাস পানি নিয়ে রিকশা থেকে রক্তটা ধুয়ে নেন।

নুরু জানালেন, সেই রাতে ও তারপর প্রায় এক সপ্তাহ তিনি ঘুমাতে পারেননি। দিনের বেলায় ফার্মগেটের ওই জায়গায় গিয়ে বসে থাকতেন। নাফিজ যেখানে উবু হয়ে পড়ে ছিল, সেই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

রিকশা বিক্রি করে দিয়েছেন নুরু

যে রিকশায় নাফিজকে তুলেছিলেন সেটা অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে এক ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন নুরু। বিক্রি করার আগে নাফিজের মা–বাবা, মামাকে এনে রিকশাটা দেখিয়েছেন। তাঁরা কিনতে চান কি না, জানতে চেয়েছেন। তাঁরা কিছু বলেননি। আর যে ব্যবসায়ী গ্রুপ কিনেছে, তারা বলেছে নাফিজের স্মৃতিকে ধরে রাখতেই এটি কেনা হয়েছে। পরে ওই রিকশাটি গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখার জন্য সংগ্রহ করেছে সরকার। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সেটি জাদুঘরে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন।

ওই রিকশা কেন বিক্রি করেছিলেন, তা ব্যাখ্যা করে নুরু প্রথম আলোকে বলেছিলেন, রিকশার পাদানিতে যেখানে নাফিজের রক্ত লেগেছিল, সে জায়গায় অন্য যাত্রীরা পা দিয়ে বসছেন, এটা তাঁর ভালো লাগছিল না। তাই রিকশা বিক্রি করে দেন। বিক্রি করে যে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন, তার সঙ্গে আর কিছু টাকা যোগ করে নতুন রিকশা বানিয়েছেন। রিকশা বিক্রি করার আগে মনে হতো, রিকশায় কে যেন লাফাচ্ছে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের পর নুরুর বাবা ঢাকায় চলে আসেন। দিনাজপুরের পীরগঞ্জের কুমারপুরে তাঁর বাবার ১২০ বিঘা জমি ছিল, তা বেহাত হয়ে যায়। সেই জমি আজও উদ্ধার করতে পারেননি। জমি ফেরত পেলে নুরুদের আর কষ্ট থাকবে না। সরকারের কাছে ‘বেহাত হয়ে যাওয়া’ জমি উদ্ধার করে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে নুরুর জন্ম। বড় হয়েছেন তেজগাঁওয়ে। কারওয়ান বাজারে কলা বিক্রি করেছেন। রিকশা চালিয়েছেন। বড় গাড়িও চালিয়েছেন। এখন থাকেন বেগুনবাড়ী বস্তিতে।

নুরুর বাবা ঢাকায় জুতা সেলাই করতেন। নুরুর দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। এক ভাই অটো চালান। মা ও বাবাকে নুরু তাঁর নিজের কাছেই রেখেছেন। নুরু ১১ বছর বয়সী ছেলে বিল্লাল হোসেনকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন। মেয়ে রোজা মনি ছোট, বয়স মাত্র দুই বছর। স্ত্রী মুন্নী। মা–বাবা পছন্দ করে বিয়ে করিয়েছেন।

রিকশার পাদানিতে থাকা গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজের ছবি ছাপা হয় মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পাতায়। এই ছবি দেখেই মা-বাবা খুঁজে পান নাফিজকে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রিকশাটা নুরুর নিজের। স্বাধীনভাবে রিকশা চালান। যেদিন পরিশ্রম বেশি করেন, সেদিন আয় ভালো হয়। রিকশা চালিয়েই চার হাজার টাকা ঘরভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালান। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি হওয়ায় সপ্তাহে হয়তো এক দিন বড় মাছ বা মাংস খান। তবে নুরু জানালেন, তিনি নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। যা কামাই করেন, সংসারের পেছনে খরচ করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে। ক্ষমতায় এখন অন্তর্বর্তী সরকার। জীবন বাজি রেখে নাফিজকে রিকশায় তুলে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য নুরু অবশ্য সরকারের কাছে কিছু চান না।

তবে নুরুর একটা ভিন্ন আরজি আছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর নুরুর বাবা ঢাকায় চলে আসেন। দিনাজপুরের পীরগঞ্জের কুমারপুরে তাঁর বাবার ১২০ বিঘা জমি ছিল, তা বেহাত হয়ে যায়। সেই জমি আজও উদ্ধার করতে পারেননি। ওই জমি ফেরত পেলে নুরুদের কষ্ট আর থাকবে না। তাই সরকারের কাছে ‘বেহাত হয়ে যাওয়া’ ওই জমি উদ্ধার করে দেওয়ার আরজি তাঁর।

নুরু বলেন, ‘সরকার চাইলে বেহাত হয়ে যাওয়া জমিটা উদ্ধার করে দিতে পারে।’

আরও পড়ুন