নজর শুধু প্রশ্নের ওপর। চেষ্টা কেবল প্রশ্নের জট খোলার। ছোট–বড় সবার একই অবস্থা। প্রতিযোগিতার মঞ্চে এসে ভুলে গেছে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তি। কারণ, স্বপ্ন তাঁদের বিশ্বজয়ের।
শুক্রবার এমন দৃশ্য দেখা গেছে জাতীয় গণিত উৎসব ২০২৫–এর পরীক্ষার কক্ষে। রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে হয় এ আয়োজন। দুই দিনের এই আয়োজনের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী পর্ব হবে আগামীকাল শনিবার। জাতীয় প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। শুক্রবার গণিত অলিম্পিয়াডের পাশাপাশি ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং, সুডোকু, রুবিকস কিউব, রোবোটিকস কর্মশালা, প্রদর্শনী দাবা খেলা এবং ড্রোন ওড়ানোর হাতেখড়ি।
সকাল ৯টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে গণিত উৎসব শুরু করা হয়। জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন স্কুলটির অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা স্বপ্নের মানুষ হয়ে নিজের ও দেশের জন্য কাজ করবে।’
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা এখানে এসেছে, তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, যারা প্রতিযোগিতা করে এখানে এসেছে, সবাই মেধাবী। ২১ বছর ধরে প্রথম আলো ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক একসঙ্গে ভালো কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই উৎসবের বিজয়ীরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। তিনি শিক্ষার্থীদের আরও বলেন, ‘যা-ই পড়ো, গণিত লাগবে।’
এই প্রতিযোগিতার জন্য সবাই সারা বছর অপেক্ষা করে বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, এই শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়েই দেশের স্বপ্নপূরণ হবে। সবার একটাই লক্ষ্য, দেশের বিজয়।
আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে। তেমনই একজন মৌলভীবাজার থেকে উৎসবে যোগ দিতে আসা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়ুষ্মান সিংহ। যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন জাতীয় পর্বের পরীক্ষা শেষে বিকেলে ড্রোন ওড়ানোর হাতেখড়ি পর্ব চলছিল। পর্ব শেষ হয়ে গেলেও তখনো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ড্রোনের এটা-ওটা দেখে সে। আয়ুষ্মানের মা সান্ত্বনা সিনহা জানান, তাঁর দুই ছেলেই এবার গণিত উৎসবে অংশ নিয়েছিল। বড় ছেলে জাতীয় পর্ব পর্যন্ত আসতে পারেনি।
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সহায়তায় হওয়া প্রদর্শনী দাবা খেলায় অংশ নিতে গণিতের আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীদের মধ্য থেকে অনলাইন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ৩২ জনকে বাছাই করা হয়। তাদের বিপরীতে খেলেন বর্তমান জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন ও বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার মনন রেজা নীর, ফিদে মাস্টার নাইম হক এবং সাবেক অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা যুব দাবায় চ্যাম্পিয়ন মহিলা ক্যান্ডিডেট মাস্টার কাজী জারিন তাসনীম। এ পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দাবা ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক লোকমান হোসেন মোল্লা। পর্বটি সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক কাউন্সিলর ও সহযোগী সদস্য এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সকাল রায়।
বাবার পাশে বসে সুডোকো মেলাচ্ছিল বরিশাল থেকে আসা আরিব সুফিয়ান। অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী এই নিয়ে দ্বিতীয়বার অংশ নিয়েছে গণিত উৎসবে। আরিবের কাছে এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বই কেনার সুযোগ। উৎসবস্থলে বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল থাকায় সে পছন্দমতো বই কিনে নিয়ে যায়। আরিবের বাবা কাওসার সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের জাতীয় উৎসবগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরির পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনুশীলন ও প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ, সব অভিভাবকের পক্ষে আলাদা করে সন্তানদের প্রস্তুত করার সুযোগ থাকে না।
আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি আবদুল হাকিম খান, সাধারণ সম্পাদক ও প্রথম আলো ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান, সহসাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন; গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া শরমিন খালেক, টালিখাতার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত উল্লাহ্ খান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক মো. হায়দার আলী বিশ্বাস, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার দেব, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দলের কোচ অধ্যাপক মাহবুবুল আলম মজুমদার। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন অ্যাসোসিয়েশন ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ফারজানা আলম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর জাহিদ হোসাইন খান।
আয়োজকেরা জানান, আগামী জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ৬৬তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নেওয়ার জন্য এই উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশ দল নির্বাচন করা হবে। এবার সারা দেশ থেকে ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী গণিত উৎসবে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি আঞ্চলিক পর্ব থেকে জাতীয় পর্বের জন্য বাছাই করা হয় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীকে। জাতীয় পর্ব থেকে বাছাই হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কয়েক ধাপে কর্মশালা শেষে আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডের জন্য নির্বাচন করা হবে একটি দল।
‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ স্লোগানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি এবারসহ ২৩ বার আয়োজন করেছে গণিত অলিম্পিয়াডের। এই আয়োজনে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে আইসক্রিম পরিবেশন করে সেভয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সহযোগিতায় ছিল ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।