শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে মানুষ হতভম্ব: প্রধান উপদেষ্টা

আজ সোমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসছবি: প্রেস উইং থেকে সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে। দেশে-বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি গভীর আগ্রহ নিয়ে এই প্রতিবেদন সংগ্রহ করছেন। দেশের মধ্যে পত্রপত্রিকা, সেমিনার, আলোচনা সভা ও টেলিভিশনে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। তাঁর ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সম্প্রচার করা হয়।

আরও পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে—এটা সবাই বুঝতে পারছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে কী পরিমাণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়ে গেছে, তার পরিমাপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারছিল না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হিসাব-নিকাশ করে এর পরিমাণ বের করে দিয়েছে।’

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন পড়ে সবাই অবিশ্বাস্য চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘কারও মুখে কথা বের হচ্ছে না। দিনদুপুরে সবার সামনে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করে নিয়ে গেছে। কেউ বলার ছিল না। কেউ দেখার ছিল না। যারা নিয়ে গেছে, তাদের কেউ বাধা দেয়নি। বরং সর্বস্তরে সবাই আগ্রহসহকারে তাদের সহযোগিতা করেছে। কারণ, তারা সব আপন লোক।’

ঋণের টাকায় বিশাল বিশাল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এসব প্রকল্পের মোড়কে বিশাল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করেছে। প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কত বেশি ব্যয় ধরে কাদের হাতে টাকাটা পাচার করে দেওয়া হয়েছে, তা-ও এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে যে বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে। দেশে এমন ধরনের পোষ্যতোষী পুঁজিবাদ তৈরি করা হয়েছিল, যার সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচার ও তার সহযোগীরা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে যে পরিমাণ করছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটা অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে দেশের শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ করা সম্ভব ছিল।

জনগণের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই। তারা প্রকাশ্যে আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে বিদেশে ভোগবিলাসে ব্যয় করেছে।’
সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায়ও পাচার করা টাকায় গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় নিয়ে একটা সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। পাচার করা এই সীমাহীন অর্থ এখন দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির কাজে ব্যয় করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রতিবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে, সেটাকেও মনগড়া বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

ড. ইউনূস বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে। কাজটা কঠিন; কারণ, এ-বিষয়ক আইন কঠিন। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে সাহস ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। বারবার বলছি, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আংশিক হলেও যেন টাকা ফেরত আনা যায়।’

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও জীবনমান উন্নয়ন

ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজন ও সংস্কার ছাড়াও আপনারা আমাদের ওপর অনেকগুলো দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে আমরা বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি পেয়েছি। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের নভেম্বরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন (৪১২ কোটি) মার্কিন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। সামগ্রিকভাবে ২০২৪ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে রপ্তানি ১৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন (১ হাজার ৬১১ কোটি) মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ১৪ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪৩৪ কোটি) মার্কিন ডলার। বছরের হিসাবে এই প্রান্তিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন (১ হাজার ৯০০ কোটি) ডলারে পৌঁছেছে। এসবের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।’

পোশাকশ্রমিকদের বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, তাঁদের বার্ষিক মজুরি ৯ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনা করে শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আমরা এখনো পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে। গত কয়েক মাসে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ও বাজার তদারকির মধ্য দিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’

আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন ড. ইউনূস। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যদি কেউ কৃত্রিম কোনো সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।

বাজার সিন্ডিকেটের (অসাধু জোট) দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বিকল্প কৃষিবাজার চালু করার লক্ষ্যে সরকারের কাজ চলছে বলে জানান তিনি।