গ্যালারির চার দেয়ালে অভ্যুত্থানের স্মৃতি

শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার দোতলায় প্রথম আলোর আয়োজিত ‘জুলাই–জাগরণ’ প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন দর্শনার্থীরা। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারিছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

তখন সন্ধ্যা। আঁধার ঘনিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। অজ্ঞাতপরিচয় এক কিশোরের মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন কিশোর তরুণ। তাদের একজন পরম মমতায় মাথাটি কোলে নিয়ে বসে আছে শহীদ মিনারের বেদিতে। ছেলেটির চোখ বন্ধ। ঠোঁট জোড়া আধখোলা। বয়স ১৫-১৬ বছর হবে হয়তো। মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। জাতীয় পতাকা দিয়ে গলার নিচ থেকে হাঁটু অবধি ঢেকে দিয়েছে কেউ। বড়ই মর্মান্তিক এই দৃশ্য ধারণ করেছিলেন আবদুল্লাহ আল যুবায়ের, ৪ আগস্ট। বিশাল আকারে প্রিন্ট করা সাদা–কালো ছবিটির সামনে দাঁড়ালে হৃদয় ছেয়ে যায় গভীর বিষাদে।

‘জুলাই–জাগরণ’ নামে প্রথম আলোর আয়োজনে যে প্রদর্শনী চলছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার দোতলায়, সেখানেই আছে নাম না জানা এই কিশোর শহীদের মর্মস্পর্শী দৃশ্যটি। জুলাই অভ্যুত্থানে বহু মানুষ অসমসাহসিকতায় জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ থেকে স্বৈরতন্ত্র অবসানের লক্ষ্যে। দেশের ইতিহাসের এই বিপুল তাৎপর্যময় অধ্যায়কে প্রামাণ্য আকারে তুলে ধরতে প্রথম আলো উদ্যোগী হয়েছে নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। প্রদর্শনী শুরু হয়েছে গত শুক্রবার, চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত আটটা এবং শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা অবধি খোলা।

প্রদর্শনীতে গণ-অভ্যুত্থান ও প্রথম আলোর সাংবাদিকতা সমন্বিতভাবে এসেছে। কয়েকটি ভাগে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন কিউরেটর আনিসুজ্জামান সোহেল। তিনি বললেন, বিপ্লব–শক্তি ও তারুণ্যের প্রতীক লাল রঙে সাজানো দেয়ালে শোভা পাচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানের আলোকচিত্র। আর ছাই রং অতীত–স্মৃতি–স্মরণ এসবের প্রতীক হিসেবে এসেছে। ছাই রঙে সাজানো দেয়ালে রাখা হয়েছে বিপ্লবকালে প্রথম আলো পত্রিকার বিভিন্ন পাতা, ক্রোড়পত্র ও বিশেষ প্রতিবেদনগুলো।

প্রদর্শনীতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মর্মস্পর্শী নানা কিছু স্থান পেয়েছে। প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন তিনি। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

পশ্চিমের দেয়ালটি সাদা, পবিত্রতার প্রতীক। এখানে শহীদের ছবি আর ব্যবহৃত সামগ্রী। শহীদ আবু সাঈদের ছবির সামনে কথা হলো তরুণ কবি জব্বার-আল-নাঈমের সঙ্গে, যিনি নিজেও অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন। বললেন, আবু সাঈদের হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো ছবি সবার দেখা। কিন্তু এখানে একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে মর্গের স্ট্রেচারে শায়িত তাঁর মরদেহ। খালি গা। সারা বুক অসংখ্য ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়া নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। সেসব বিভ্রান্তির জবাব হিসেবে এই ছবিটি একটা দারুণ প্রমাণ হয়ে এসেছে।

শহীদদের সামগ্রী নিয়ে সাজানো অংশের নাম ‘শহীদ স্মরণ’। এখানে ছয় শহীদের ছবি, পরিচিতি, প্রথম আলোর প্রতিবেদনের প্রিন্ট রয়েছে দেয়ালে। আছে পারিবারিক ছবি, কিছু ব্যবহৃত সামগ্রী। দেয়ালের সামনে রাখা টেবিলেও আছে নানা রকম সামগ্রী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের ব্যবহার্য নানা কিছু স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ আর তাঁর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, বয়স বছর দুয়েক হবে। এক ছবিতে দুই নাতিকে কোলে নিয়ে আছেন দাদা। আরও অনেকগুলো পারিবারিক ছবিতে আছে শিশু মুগ্ধের তরুণ হয়ে ওঠার সোনালি দিনগুলো। আছে তাঁর ল্যাপটপ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার ব্যাজ, বইখাতা, ক্রেস্ট।
নাঈমা সুলতানার এবার এসএসসি দেওয়া কথা ছিল। সে শহীদ হয়েছিল ১৯ জুলাই। মাত্র তিন দিন আগে খাতায় স্বৈরাচারের অবসানের এক চমৎকার ছবি এঁকেছিল। সেই ছবিটিও আছে প্রদর্শনীতে। আরও আছে তার কামিজ, অলংকার, প্রসাধনী, স্কুলের পোশাক। আর আছে মাথায় গুলিবিদ্ধ ছবি।

অনেকগুলো পদক পেয়েছিল বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শাফিক উদ্দিন আহমেদ। গান গাইত ভালো। সেই পদক, প্রিয় গিটার, সবই আছে। কেবল সে আর নেই।

খেলাধুলায় খুব আগ্রহ ছিল মাহমুদুর রহমান সৈকতের। ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন ব্যাট, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে অর্জন করা ক্রেস্ট সাজিয়ে রাখা হয়েছে হাস্যোজ্জ্বল সৈকতের ছবির সামনে। ভাবাই যায় না, ঝরে গেছে এই তরতাজা প্রাণ।
এখানে আছে ছয় বছরের শিশু জাবির ইব্রাহীমের সাইকেল, স্পাইডারম্যান পুতুল, স্কুলের ব্যাগ আর খাতা। মলাটে লেখা ‘নাম: জাবির ইব্রাহীম, রোল নং ২১১০৬১, শ্রেণি: নার্সারি, বিষয়: অঙ্ক’। পাশেই তার রক্তমাখা জামাটি বলে দিচ্ছে জীবনের অঙ্ক আর মেলানো হবে না অবোধ শিশুটির। স্কুলে আর পড়বে না তার পায়ের চিহ্ন। মা–বাবার কোল খালি করে দিয়েছে পুলিশের নির্মম বুলেট।

প্রদর্শনীর ‘সত্যে তথ্যে জুলাই’ অংশে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের নিদর্শন দেখছেন একজন। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

‘সত্যে তথ্যে জুলাই’ অংশে আছে পত্রিকা, প্রতিবেদনের নিদর্শন। ছবি আছে ‘ক্যামেরায় বিদ্রোহ’ এবং ‘জুলাই–জাগরণ’ অংশে। ‘রক্তাক্ত স্মারক’ অংশে সাজানো আন্দোলন দমন করতে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী বুলেট ও রবার বুলেটের খোসা, ছররা গুলি, গ্রেনেডের পিন, কাঁদানে গ্যাসের খোসা এসব। ‘আবু সাঈদ: আন্দোলন ও শিল্পের প্রতীক’ অংশে আছে তাঁকে নিয়ে করা শিল্পী শহীদ কবীরের শিল্পকর্ম, শিল্প তৈরির উপকরণ ও প্রক্রিয়ার ভিডিও চিত্র।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনের নিদর্শন রয়েছে প্রদর্শনীতে। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

এর পাশাপাশি প্রদর্শনীতে দুটি কক্ষের মনিটরে দেখানো হচ্ছে অভ্যুত্থানের সময়ের প্রথম আলো অনলাইনে সম্প্রচারিত প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও। আজ শনিবার প্রচুর দর্শক এসেছিলেন প্রদর্শনীতে। গুলশানের নর্দা থেকে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন আইনজীবী শাহনেওয়াজ খান। খিলগাঁও থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে আনিসুন নবী এসেছিলেন স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে। তাঁরা বললেন, গ্যালারির চার দেয়ালের ভেতরে জুলাই অভ্যুত্থান তার সামগ্রিকতা নিয়ে উঠে এসেছে। প্রথম আলোর এটি একটি খুবই সময়োপযোগী আয়োজন।

রোববারের অনুষ্ঠান: প্রদর্শনী উপলক্ষে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। এসব অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল চারটায়। রোববার থাকবে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে চারটি বইয়ের প্রকাশনা ও আলোচনা।