২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে আইনটি নিয়ে নানা রকম আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে। গত প্রায় পাঁচ বছরে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, অ্যাকটিভিস্ট ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। এ রকম প্রেক্ষাপটে আইনটি স্থগিত ও বাতিলের দাবি উঠেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আইনটি বাতিল না করে সংশোধনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী হিসেবে সাইবার বিষয়ক মামলা–মোকদ্দমা পরিচালন করার অভিজ্ঞতা থেকে এ আইনের কিছু বিষয়ে অসঙ্গতি চোখে পড়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে—(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তা হইবে একটি অপরাধ।’ এ ধারায় ব্যবহৃত ‘প্রেরণ’ শব্দটি বিভ্রান্তিমূলক। এই বিভ্রান্তির সুযোগে আইনটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে। ‘প্রেরণ’ শব্দটিকে নানাভাবে এবং সুবিধামতো ব্যাখ্যা করার কারণে নিরপরাধ ব্যক্তিও এই ধারায় ফেঁসে যাচ্ছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধি, ১৮৬০–এর ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানির ব্যাখ্যায় দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ৪৯৯ ধারার ব্যাখ্যাগুলো সুনির্দিষ্ট করে আইনে বলে দেওয়া নেই। ফলে ৪৯৯ ধারায় আসলে কী আছে, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা অভিযোগকারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খতিয়ে দেখেন না—এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধারায় শাস্তি দণ্ডবিধির ৫০০ ধারার (মানহানির শাস্তি) চেয়ে বেশি। দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত অপরাধের জন্য শাস্তির ক্ষেত্রে ৫০০ ধারায় দুই বছরের কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে একই অপরাধ ডিজিটাল মাধ্যমে করলে সেক্ষেত্রে এ আইনে ৩ বছরের কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে একই অপরাধ ভিন্ন শাস্তি হয়ে যাচ্ছে যা ন্যায়ঙ্গত নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এ ধারায় উল্লেখিত ‘সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে’—এসব কথার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ফলে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩– এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ ধারায় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের কথা বলা হলেও তা সুনির্দিষ্ট হয়নি। তারচেয়ে বড় কথা, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি একটি আইন। এ আইন যুগোপযোগী নয় এবং এটি নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। এর ফলে আইনটি অপপ্রয়োগের একটি বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে এবং এর অপব্যবহারও হচ্ছেও।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে, উক্ত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে কোম্পানির এইরূপ প্রত্যেক মালিক, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা প্রতিনিধি উক্ত অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করিতে সক্ষম হন যে, উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে হইয়াছে বা উক্ত অপরাধ রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।’ আইনের ধারায় ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা প্রতিনিধিকে সংযোজন একটি মারাত্মক ত্রুটি এবং আইনের একটি সীমাবদ্ধতাও বটে। এখানে বলা হয়েছে, কোম্পানি অপরাধ করলে তার কর্মকর্তা–কর্মচারী অভিযুক্ত হবেন যদিও যদি না তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে উক্ত অপরাধ তাঁর অজ্ঞাতসারে হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি কীভাবে তাৎক্ষণিক প্রমাণ করবে যে, সে অভিযুক্ত নয়? এ আইনে মামলা হলে পর গ্রেপ্তার হতে হয় কিংবা আদালতে জামিন চাইতে হয়। এ ক্ষেত্রে অজামিনযোগ্য ধারা হলে তাৎক্ষণিকভাবে কোন কর্মকর্তা জড়িত আছে বা নেই, তা আমাদের বিচারব্যবস্থায় প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এ কারণে আইনের এ ধারাও হয়রানিমূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর থেকেই এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, অ্যাকটিভিস্টরা তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে আইনটি ভিন্ন মত দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করতে পারে। আইনটির বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে তাদের এ আশঙ্কা অনেকটাই সত্য বলে প্রমাণ হয়েছে।
তানজিম আল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী